ঈদের রাতেও রাস্তায় ঘুমাতে হবে

রাত ১২টা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মূল সড়কের ফুটপাত। এক ব্যক্তি তাঁর শরীরে কাঁথার মতো মশারি জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছেন। শরীরের সঙ্গে মশারি লেপ্টে ছিল। কারণ, মশারি টানানোর কোনো সুযোগ সেখানে নেই। মিনিট পাঁচেক পরে উনি মশার কামড়ে জেগে উঠলেন। পায়ের পাশে একটি কাঁথা রাখা ছিল। মশারির ওপর দিয়েই সেটি জড়িয়ে নিলেন শরীরে।
ঘড়ির কাঁটায় তখন ১২টা ১৯ মিনিট। একদল যুবক এলেন। ওই ব্যক্তিসহ আশপাশের ফুটপাতে ঘুমন্ত কয়েকজনকে ডাকলেন। যুবকেরা জনপ্রতি এক প্যাকেট করে বিরিয়ানি দিয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণের ভেতর সবাই আবার ঘুমিয়ে গেলেন। কিন্তু মশারি পেঁচিয়ে থাকা ব্যক্তি জেগে রইলেন। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন।
কথা হয় ওই ব্যক্তির সঙ্গে। নাম মনা মিয়া। বয়স ৬০ বছর। তিনি দাবি করেন, ‘৪০ বছর ধরে ঢাকায় থাকি। এই ৪০ বছরের পুরোটা সময় রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে দিয়েছি। কখনও এ রাস্তায়, কখনও ওই রাস্তায়। কখনও রাস্তার মোড়ের দোকানের নিচে। জীবনটা এভাবে কেটে গেল। ২০ বছর বয়সে রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসি। তারপর থেকে ঢাকায় থাকি। খুব কম গ্রাম দেখতে যাই। গ্রামে তেমন কেউ নেই। সে জন্য যেতে ইচ্ছে করে না। ঈদেও যাব না। ঈদের রাতেও আজকের মতো ঘুমিয়ে থাকব।’
কখনও বিয়ে করেননি বলে জানান মনা মিয়া। কয়েকবার জানতে চাওয়ার পরও বিয়ে না করার কারণ খোলসা করেননি তিনি। অবশ্য একবার বলছিলেন, ‘রাস্তায় বউ রাখা যায়?’
কথা বলার ফাঁকে এক সময় মনা মিয়া জানান, শুরুতে তিনি অনেক রকম কাজ করতেন। একটা সময় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পান-সিগারেট বিক্রি করতেন। সে সময় তাঁর ভালোই চলতো। কিন্তু ১০ বছর আগে স্ট্রোক করেন।

‘স্ট্রোক করার পর থেকে আর কাজ করতে পারি না। মানুষের কাছে চেয়ে চেয়ে খেতে হয়। কিছু করার নেই। জীবনটা এমন হয়ে গেছে।’
মশারি না টাঙিয়ে জড়িয়ে রাখা প্রসঙ্গে মনা মিয়া বলেন, ‘মশারি যে টানাব, চারিপাশে টানানোর জায়গা তো নেই। রাস্তায় কী আর ঘরের মতো সুবিধা থাকে? সে জন্য গায়ে জড়িয়ে রাখি। গরম বেশি পড়লে অসুবিধা হয়। তখন মশারি গায়ে জড়িয়ে রাখা যায় না। আবার মশারি না জড়ালে ঘুমানো যায় না।’
মনা মিয়া দিনের বেলা মশারি, কাঁথা ও বিছানা রেখে দেন কারওয়ান বাজারের একটি জায়গায়। ১০ টাকা দিয়ে দুপুরে গোসল করেন। টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হলে যান পাবলিক টয়লেটে।
মনার পাশেই একটি বিছানা পেতে বসেছিলেন রফিকুল ইসলাম। ২ বছর আগে তিনি বাগেরহাট থেকে ঢাকায় আসেন। রাতে ফুটপাতে ঘুমান। দিনে কারওয়ান বাজারে মিনতির কাজ করেন। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করেন। কখনও বেশি। নিজে কিছু টাকা খরচ করেন। বাকিটা গ্রামে পাঠিয়ে দেন।
রফিকুল ইসলামের তিন ছেলে-মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ১২ বছরের এক ছেলে আছে তাঁর। এ ছাড়া স্ত্রী আর বাবা-মা থাকেন গ্রামে। ২৭ মার্চ তিনি ফিরতে চান পরিবারের কাছে। তিনি বলছিলেন, ‘ঈদের সময় অনেক খরচ। কিছু টাকা তো গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। গাড়ি ভাড়ার ব্যাপার আছে। কাছে তেমন টাকা নেই। টাকা ছাড়া গ্রামে তো যেতে পারছি না। দেখি আরও কিছু টাকা আয় করা যায় কিনা। ঈদে ছেলেটার জন্য কিছু একটা কেনা দরকার। কিন্তু পারছি না কিনতে।’
ফুটপাতে ঘুমানোর বিষয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এত টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকার সুযোগ নেই আমার। টাকা বাঁচানোর জন্যই দুই বছর ধরে ফুটপাতে থাকি। মাঝেমধ্যে গ্রামে যাই। ছেলে-মেয়েদের দেখে আবার চলে আসি।’