ডিইপিজেডে বিদ্যুৎ সংকটে উদ্বিগ্ন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় সাভারে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে বিনিয়োগকারীরা। বিদ্যুৎ সংকটে থমকে গেছে অধিকাংশ কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপনা। পুরোদমে কারখানা চালু করতে না পারায় কর্মীদের বিশ্রামে পাঠানোর পাশাপাশি বিপুল অংকের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের নানা প্রশ্ন এবং উদ্বেগে চাপে রয়েছেন বেপজা কর্মকর্তারাও।
এমন পরিস্থিতিকে বিনিয়োগ পরিবেশের পরিপন্থী উল্লেখ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা।
ঢাকা ইপিজেডে বর্তমানে কার্যকর ৯০ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ বিদেশি। আর এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন প্রায় এক লাখ কর্মী। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য শিল্প এলাকা বেসরকারি ইউনাইটেড পাওয়ারের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ওপর নির্ভরশীল। তবে বিপুল পরিমাণ বিল বকেয়া-সংক্রান্ত জটিলতাকে সোমবার দুপুরে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর বিদ্যুৎ সংকটের কবলে পড়ে শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলো। বন্ধ হয়ে যায় রপ্তানি নির্ভর গুরুত্বপূর্ণ বিশেষায়িত এই শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ কারখানার উৎপাদন।
ইউনাইটেড গ্রুপের ৮৬ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক এই কেন্দ্র থেকে ইপিজেডের কারখানাগুলোর জন্য দৈনিক ৪৫-৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে বলা হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উৎপাদন থমকে যাওয়ায় অস্বস্তির মধ্যে পড়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
ডিইপিজেডে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সিকেডিএল এর এইচআর, এডমিন এন্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার মেজর (অব.) আবদুল্লাহ-আল-মাহমুদ জানান, দেশে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটে হলেও আমরা রপ্তানি পণ্য উৎপাদনের স্বার্থে এতদিন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতাম। চলমান সংকটে আমরা নিজস্ব ব্যাকআপ জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চালু রেখেছি। কিন্তু এটাও তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা চালানো যায় না। রেস্ট দিতে হয়। দুটি কারখানা মিলে বয়লার এবং জেনারেটর চালাতে গিয়ে ইতোমধ্যে অতিরিক্ত ২০ হাজার ডলার ব্যয় হয়েছে। দুটি কারখানায় শিফট চালাতে গত দুদিনে আমাদের ৩২ হাজার ডলারের আর্থিক ক্ষতি গুনতে হয়েছে। পানি নিয়েও সমস্যা। বেপজার পানি সরবরাহ বন্ধ। এতকিছু করে আমরা যে স্ট্যান্ড বাই জেনারেটর চালাচ্ছি তাতেও পুরো কারখানায় কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। ফ্যান ও এসি বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এত গরমে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে শ্রমিকরাও অসুস্থ হয়ে পড়বে।
এভাবে চলতে থাকলে যা আয় করবো তার সবটাই যদি ব্যয় হয় তাহলে আর শিল্প কারখানা চালিয়ে রাখার অর্থ কি? এ অবস্থা চলতে থাকলে মাসে সাড়ে সাত কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে। ১০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান বজায় রাখা আমাদের আর সম্ভব নাও হতে পারে। শিল্পই ধবংস হয়ে যাবে।
একই পরিস্থিতি ডিইপিজেডের অন্যান্য কারখানাগুলোতেও। বিদ্যুৎ নিয়ে সর্বত্রই দেখা গেছে হাহাকার।
ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক মো. শরীফুল ইসলাম জানান, জরুরি ভিত্তিতে আমরা বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে সরকারের উচ্চ মহলকে অবহিত করেছি। আজ (মঙ্গলবার) বিদ্যুতের অভাবে আরও ৫টি কারখানার শ্রমিকদের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। আমরা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে চাহিদা মতো সরবরাহ বাড়াতে বলেছি। তারা আমাদের ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পেরেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ৭০ ভাগ কারখানার চাহিদা পূরণ করা গেলেও ৩০ ভাগ কারখানার নিয়ে সমস্যা রয়ে গেছে। আশা করি দুএকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসির উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী কে এম মনিরুল ইসলাম জানান, ইউনাইটেড গ্রুপের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে সংস্থাটির বকেয়া ৪৭৮ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের পর থেকে পুঞ্জীভূত বকেয়ার বিষয়ে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও ইউনাইটেড বকেয়া পরিশোধ করেনি। পাওনা আদায়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
শিল্প-কারখানাগুলো পুরোদমে উৎপাদনে যেতে কতটা সময় লাগবে সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বেপজার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
দেশে শীর্ষ ১০ বিদেশিসহ দেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাপানের ওয়াই কে কে বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড, ইন্দোনেশিয়ার রিং শাইন টেক্সটাইলস লিমিটেড, যুক্তরাষ্ট্রের প্যাক্সার বাংলাদেশ লিমিটেড, চীনের (হংকং) সাউথ চায়না ব্লিচিং অ্যান্ড ডায়িং ফ্যাক্টরি লিমিটেড, গোল্ডটেক্স লিমিটেড, বাংলাদেশের শাশা ডেনিম লিমিটেড, ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়ংওয়ান হাই-টেক স্পোর্টসওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বাংলাদেশের ইওএস টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড এবং ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডের হপ-ইক (বাংলাদেশ) লিমিটেডসহ বিনিয়োগ শিল্প কারখানাগুলোতে এখন হাহাকার চলছে বিদ্যুতের জন্যে।
যোগাযোগ করা হলে জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, ‘ইউনাইটেডের কাছে বকেয়া গ্যাস বিলের জন্যে দীর্ঘদিন তাগাদা দেওয়া হলেও তারা বিষয়টি নিষ্পত্তি করেনি। বকেয়ার কিছু অংশ পরিশোধ করলে তিতাসকে বিষয়টি বিবেচনা করতে বলা হবে।
তবে ইউনাইটেড গ্রুপ বলছে ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, চুক্তি অনুযায়ী তিতাস কোনো বকেয়া বিল পাবে না। তাদের সরবরাহকৃত সব বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
ইউনাইটেড গ্রুপের হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স মো. শামীম মিয়া বলেছেন, ‘আমাদের কোনো বিল বকেয়া নেই। গত মাস পর্যন্ত গ্যাসের পাওনা বিল পরিশোধ করেছি। গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগে তিতাস কোনো নোটিশও দেয়নি। তিতাসের কাছ থেকে গ্যাস নিয়ে ঢাকা ইপিজেডের কারখানাগুলোয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি। যেহেতু তিতাস গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে, আমাদের এখন কিছু করার নেই।’
এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারী দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো পড়েছে ক্ষতির মুখে। তৈরি হয়েছে রপ্তানির এই বৃহৎ খাতে অস্বস্তির পাশাপাশি গভীর অনিশ্চয়তা।