সেশনজট ও রাজনীতিমুক্ত হিসেবে সুনাম অর্জন

মাত্র চারটি বিভাগে ৮০ জন শিক্ষার্থী আর একটি মাত্র দুই তলা ভবনে যাত্রা শুরু করা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ২৪ বছর পার করে দেশের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি ও সেশনজট মুক্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকারও শীর্ষে উঠে এসেছে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের নিরলস প্রচেষ্টা ও দীর্ঘদিনের আন্দোলন। দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রামের পর ১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি গেজেটে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সরকারি সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালের ৯ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহ্ম্মদ এরশাদ প্রথম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করেন। ১৯৯০ সালের জুন মাসে জাতীয় সংসদে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়, যা গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ওই বছর ৩১ জুলাই। ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে চারটি ডিসিপ্লিনে ৮০ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়। ১৯৯১ সালের ৩০ আগস্ট প্রথম ওরিয়েন্টেশন এবং ৩১ আগস্ট ক্লাস শুরুর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা হয়। পরে একই বছরের ২৫ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
২০০২ সালের ২৫ নভেম্বর ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে পালিত হয় প্রথম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। এরই ধারাবাহিকতায় সেই থেকে প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সেশনজট, সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রমের ২৪ বছর পূর্ণ করেছে গত বছর ২৫ নভেম্বর।
মহানগরী খুলনা থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক সংলগ্ন ময়ূর নদীর পাশে এক মনোরম পরিবেশে গল্লামারীতে ১০১ একর জমির ওপর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও সংলগ্ন এলাকাটি ছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এক বধ্যভূমি। প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নবম। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী এবং ভবিষ্যতের চাহিদার নিরীখে এখানে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিষয়ের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা, এনভায়রমেন্টাল সায়েন্স ও বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয় দেশে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কোর্স খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম চালু করা হয়। এ ছাড়া স্থাপত্য ও ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কোর্স ঢাকার বাইরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বুয়েটের পরই ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স ক্রেডিট পদ্ধতি চালু হয়।
বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি স্কুলের (অনুষদ) অধীনে ২১টি ডিসিপ্লিন (বিভাগ) এবং একটি ইনস্টিটিউটে (চারুকলা) অধীনে তিনটি ডিসিপ্লিন শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত ব্যাচেলর ডিগ্রি, ব্যাচেলর অব অনার্স ডিগ্রি, মাস্টার্স ডিগ্রি, এম ফিল এবং পিএইচ ডি প্রদান করা হয়। স্কুলগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান, প্রকৌশলও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুলের আওতায় রয়েছে আর্কিটেকচার, আরবান অ্যান্ড রুরাল প্লানিং, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত, পদার্থ, রসায়ন বিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন।
জীববিজ্ঞান স্কুলের আওতায় রয়েছে ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি, ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাগ্রোটেকনোলজি, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ফার্মেসি ও সয়েল সায়েন্স ডিসিপ্লিন। ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায় প্রশাসন স্কুলের আওতায় রয়েছে ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন। কলা ও মানবিক স্কুলের আওতায় রয়েছে ইংরেজি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ডিসিপ্লিন। সমাজ বিজ্ঞান স্কুলের আওতায় আছে অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান ও ডিভেলপমেন্ট স্টাডিজ ডিসিপ্লিন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ইনস্টিটিউটের নাম চারুকলা ইনস্টিটিউট। এর আওতায় তিনটি ডিসিপ্লিন চালু হয়েছে, এগুলো হলো ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং, প্রিন্ট মেকিং ও ভাস্কর্য ডিসিপ্লিন।
এ ছাড়া সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড স্টাডিজ অন দি সুন্দরবনস (সিআইএসএস), রিসার্স সেল, মডার্ন ল্যাংগুয়েজ সেন্টারও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার মান বিশ্বমান অর্জনে সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ইন টিচিং অ্যান্ড লার্নিং (সিইটিএল) এবং ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি এসুরেন্স (আইকিউএসি) সেল নামে দুটি পৃথক সেল গঠন করা হয়েছে। এ দুটি সেলের কার্যক্রমও ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষক সংখ্যা ৩৭২ জন। ছাত্রছাত্রী রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি, এর মধ্যে বিদেশি ছাত্রছাত্রী ১২ জন। এ ছাড়া কর্মকর্তা ২২০ জন এবং কর্মচারী রয়েছে তিন শতাধিক।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিশেষ করে নবীন শিক্ষকরা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় স্কলারশিপ পাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি সংস্থার গবেষণা সহায়তাও বাড়ছে। কর্তৃপক্ষ শিক্ষা ও গবেষণা কর্মকাণ্ডের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও উন্নত বিশ্বের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার বিশেষজ্ঞরা, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, বিজ্ঞানী ও গবেষকরা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন। কানাডা, জাপানের কয়েকটি দেশের সাথে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ বাড়াতে ক্যাম্পাসে ইতিমধ্যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার স্থাপিত হয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে তিনটি একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবন, তিনটি আবাসিক হল, মেডিকেল সেন্টার, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য পাঁচটি বাসভবন, অগ্রণী ব্যাংক শাখা, ডাকঘর ও মসজিদ। ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের জ্ঞান সহায়তায় রয়েছে সমৃদ্ধ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবন ও শার্লী ইসলাম গ্রন্থাগার ভবন। এ ছাড়া ক্লাব কাম গেস্ট হাউস, কেন্দ্রীয় মসজিদ, মন্দির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। ছাত্রদের জন্য আরো একটি আবাসিক হল এবং মেয়েদের জন্য আরো একটি আবাসিক হলের নির্মাণকাজ শেষের পথে।
দেশের তথা দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের উচ্চ শিক্ষার বিকাশে স্থানীয় সম্পদ আহরণ, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন জনসম্পদ সৃষ্টি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধির সোপানে এগিয়ে নেওয়া এবং সম্ভাবনার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ বাস্তবায়নে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার কাজ এগিয়ে চলেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা সাফ্যল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে অগ্রসর হচ্ছে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে।
খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ এবং বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলার ড. মোহাম্মদ ফায়েকুজ্জামন। ভাইস চ্যান্সেলর ড. মোহাম্মদ ফায়েকুজ্জামান বলেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সময় উপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয় এগিয়ে যাচ্ছে। এই বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দেশসেবা করে চলেছে। বলেন এই বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের কর্ম সংস্থানের কোনো সমস্যা হয় না। তিনি জানান, এই বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য একটি আসনের বিপরীতে ৬৫-৬৬ জন শিক্ষার্থী থাকে। এটা হয়েছে এই বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ও শিক্ষার পরিবেশ ভালো থাকায় ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহের কারণে।