বাবা দিবস
ভালোবাসার পরিচয় দায়িত্ব পালনে
‘বাবা’ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজন দায়িত্বশীল ভালোবাসার মানুষের ছবি। যাঁর সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা থাকে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ। এই বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ও ভালোবাসা প্রকাশে পৃথিবী জুড়ে সবাই পালন করে ‘বাবা দিবস’।
মায়েদের পাশাপাশি বাবারাও সন্তানের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেন ও আজীবন সন্তানের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যান, বাবা দিবসে বাবাদের সেই মহত্ত্বকে স্মরণ করা হয়। কিন্তু বাবা কি শুধুই নির্দিষ্ট দিনে সম্মান ও ভালোবাসা পাওয়ার পাত্র; আজীবন যিনি সন্তানের জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে এসেছেন, কেবল একটি দিনের ভালোবাসার মধ্যে দিয়েই কি সে ঋণ শোধ করা সম্ভব? ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই প্রথম বাবা দিবস পালিত হয়েছিল আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেরামেন্টের একটি গির্জায়। তারপর ১৯১০ সালে ওয়াশিংটনে সনোরা ডট নামের এক ভদ্রমহিলা নিজ উদ্যোগে তার বাবার জন্য ১৯ জুন ‘বাবা দিবস’ পালন করেন। তার পর থেকে একটি নির্দিষ্ট দিনে প্রতিবছর ‘বাবা দিবস’ পালিত হয়ে আসছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ‘মা দিবস’ পালন শুরু হয়েছিল ১৮৫৮ সালে পশ্চিম ভার্জিনিয়াতেই। কিন্তু যে উদ্যমে মা দিবস পালিত হতে দেখা যায়, ‘বাবা দিবস’ তেমনভাবে পালিত হতে দেখা যায়নি। অন্যান্য জাতীয় দিবসের মতো ‘বাবা দিবস’ পালন করার জন্য এই দিনটিকে ছুটির দিন ঘোষণা করার আবেদন জানিয়ে ১৯১৩ সালে আমেরিকায় একটি বিল উত্থাপন করা হয়। দীর্ঘ ৫৩ বছর পর ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসন ‘বাবা দিবসকে’ ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকেই সাড়ম্বরে ‘বাবা দিবস’ পালন শুরু হয়।
জন্মদাতা, পিতা, জনক বা বাবাকে আমরা বাবা (বাংলা); পিতাজি (হিন্দি); ফ্যাট্যা (জার্মান); ওটেক (ক্রোয়েশিয়া); ড্যাডি (ইংরেজি); উপ্পা (কোরিয়া); ফার (ড্যানিশ); ওতোসাং (জাপানি) ইত্যদি যে ভাষাতেই ডাকি না কেন, তার প্রতি ভালোবাসা কোনো ভাষাতেই কম প্রকাশিত হয় না। ধর্ম থেকে শুরু করে পরিবার ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পুরুষের আধিপত্য ও গুরুত্ব সর্বজন স্বীকৃত। পরিবারে বাবার অবস্থান তাই অন্যান্য সদস্যের তুলনায় যেমন গুরুত্ববহ তেমনি সুদৃঢ়। তবে ভালোবাসার ক্ষেত্রে সন্তানেরা মাকে যেমন আপন করে নিতে পারে, বুঝতে পারে, বিভিন্ন কারণে বাবার ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে না। সন্তানের বাবার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ তাই বেশির ভাগ সময়ে আড়ালেই থেকে যায়। কিছুকাল আগেও ‘মা দিবসের’ মতো তোড়জোড় বাবা দিবসে ছিল না। কিন্তু বর্তমানে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ ‘বাবা দিবস’ বেশ আগ্রহ সহকারে পালন করে থাকে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রোববার এই দিনটি পালিত হলেও ২৩ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ায়; ১৯ মার্চ বলিভিয়া, পর্তুগাল, হন্ডুরাস, স্পেন ইত্যাদি দেশে; মে মাসের দ্বিতীয় রোববার রোমানিয়ায়; জুনের প্রথম রোববার সুইজারল্যান্ড, লিথুনিয়ায়; আগস্টের দ্বিতীয় রোববার ব্রাজিলে; সেপ্টেম্বরের প্রথম রোববার অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি প্রভৃতি দেশে, অক্টোবরের প্রথম রোববার লুক্সেমবার্গে; এভাবে বছরের প্রতিটি মাসে কোনো না কোনো দেশে ‘বাবা দিবস’ পালিত হচ্ছে।
বাবা ও মা পৃথিবীর সব থেকে প্রিয় দুটি শব্দ যার কোনো বিকল্প নেই, যার তুলনাও কারো সাথে চলে না। কিন্তু যেই বাবা দিবস নিয়ে আমাদের এত মাতামাতি সঠিক সময়ে সেই বাবার প্রতি সদাচরণ কি আমরা আদৌ করে থাকি? যেই সন্তান আজ সামর্থ্যবান বাবার জন্য এই দিবসটি হই হুল্লোড় করে পালন করছে, আজ থেকে ৩০ বছর পর বৃদ্ধ বাবার জন্য সেই একই উদ্যম কি তার বজায় থাকবে? লক্ষণীয় বিষয় হলো, ‘মা দিবস’ বা ‘বাবা দিবস’ যাই হোক না কেন, মা-বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও দায়িত্ব কখনোই একটি দিবসে সীমাবদ্ধ হতে পারে না। ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে বৃদ্ধ হলেই বাবা-মাকে ওল্ড হোমে পাঠানোর নিয়ম বহু আগে থেকেই ছিল, তাই তারা বছরের একটি দিন পুরোপুরি বাবা-মায়ের সঙ্গে কাটাতে চাইত বলে তাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই দিবসগুলো যতটা গুরুত্ব বহন করে আমাদের ক্ষেত্রে ততটা নয়। আমরা যৌথ পরিবারে থেকে অভ্যস্ত। আমাদের পরিবারগুলো মৃতুর আগ পর্যন্ত বাবা-মায়ের ছায়াতলে লালিত হয়ে আসছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বিশ্বায়নের প্রভাবে আর নগরায়ণের সুবিধা ভোগ করতে গিয়ে আমরা আমাদের যৌথ পরিবারগুলো হারিয়ে ফেলেছি। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের নামে আমরা অণু পরিবার গঠনে আগ্রহী। তাই বছরের বেশির ভাগ সময়টাই আমরা বাবা-মা থেকে দূরে অবস্থান করি। বয়স বাড়তেই তাঁদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর চিন্তায় মশগুল হই। বর্তমানে বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রম আছে প্রায় ৫৫টির মতো। ২০০৯ সালে সরকার প্রতিটি বিভাগে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কেন এই বৃদ্ধাশ্রম? বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা আজ কেবল দিবস দিয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে দিন দিন বাংলাদেশের মতো যৌথ পরিবারকেন্দ্রিক দেশগুলোতেও মা-বাবার প্রতি টান এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শেষ বয়সে যখন সন্তানের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তখনই তাঁদের যেতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। সইতে হচ্ছে মানসিক যন্ত্রণা।
আজকের ‘বাবা দিবস’ পালন তখনই সার্থকতা অর্জন করবে যখন একজন সন্তান প্রতিজ্ঞা করবে যে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত বাবা মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব সেই বহন করবে, কোন বৃদ্ধাশ্রম নয়। যেদিন এ দেশের সব সন্তান বাবার প্রতি তাদের প্রকৃত ভালোবাসা অনুধাবনে সক্ষম হবে, যেদিন কোনো বৃদ্ধ বাবাকে আর কষ্টে দিনাতিপাত করতে হবে না সেদিনই বাবারা তাঁদের ভালোবাসার সঠিক মূল্যায়ন পাবেন। তখন কৃত্রিম ভালোবাসা চিহ্নায়নের জন্য কোনো বাবা দিবসের প্রয়োজন হবে না।