ছেলে ও মেয়ের নিছক বন্ধুত্ব হয় কি?
তনয় আর লামিয়ার পরিচয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পরপরই। একে অপরের প্রতি আস্থা আর নির্ভরতাও নিতান্ত কম নয়। লামিয়া বাসে উঠতে পারত না বলে তনয় প্রতিদিন বাসে করে লামিয়াকে বাসায় পৌঁছে দেয়। বৃষ্টি-বাদলা, অসুস্থতা যেটাই থাকুক, তনয় নিজেই লামিয়াকে বাসায় পৌঁছে দেবে। অন্যদিকে লামিয়াও কম যায় না। তনয় পড়ালেখায় কিছুটা অমনোযোগী বলে প্রতি ক্লাসের লেকচার ফটোকপি করে সেটা তনয়ের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার কাজটা লামিয়াই করত। তনয় আর লামিয়ার এই সম্পর্ক নিয়ে অন্য ক্লাসমেটদের কৌতূহলের শেষ ছিল না। কেউ কেউ তো মাঝেমধ্যে লামিয়া আর তনয়কে জেঁকে ধরে জেরা করত; বলত, ‘তোদের মধ্যে আসলে কী চলে?’ অনেকে তো ধরেই নিয়েছিল, নিশ্চয়ই লামিয়া-তনয়ের ভেতর গভীর প্রেম চলছে। কিন্তু তারা প্রকাশ করছে না।
সবার কৌতূহল বিস্ময়ে রূপ নিল যখন ওদের ক্লাসমেটরা ধীরে ধীরে আবিষ্কার করল, লামিয়ার সঙ্গে প্রীতম নামের একটা ছেলের গভীর প্রেমের সম্পর্ক, আর তনয় ভালোবাসে অনিন্দিতা নামের এক মেয়েকে; কিন্তু সেটা সে অনিন্দিতাকে এখনো জানাতে পারেনি। লামিয়ার প্রেমিক প্রীতম মানুষ হিসেবে যথেষ্টই উদার। তনয় আর লামিয়ার নিষ্কাম বন্ধুত্বটা নিয়ে সে কখনই আপত্তি করেনি; বরং মাঝেমধ্যেই তনয়-লামিয়া-প্রীতম একসঙ্গে বাইরে ঘুরতে যেত, খাওয়াদাওয়া করত, আড্ডা দিত। এর ভেতরে প্রীতম-লামিয়া উদ্যোগ নিয়ে অনিন্দিতাকে জানিয়ে দিল, তার প্রতি তনয়ের দুর্বলতার কথাটা। কিছুদিনের ভেতর তনয় আর অনিন্দিতার ফেসবুক আইডিতে দেখা গেল ‘In a relationship’ স্ট্যাটাস। তনয়-লামিয়াকে নিয়ে সবার যে সন্দেহটা ছিল, সেটা কেটে গেল। সবাইই বুঝতে পেরেছিল, তনয়-লামিয়ার সম্পর্কটা শুধুই বন্ধুত্বের। হয়তো সমীকরণটা সহজেই মিলে যেতে পারত। কিন্তু অনিন্দিতা কখনই মানসিকভাবে লামিয়ার প্রতি তনয়ের অযথা যত্নটা মেনে নিতে পারত না। তনয় যে প্রতিদিন লামিয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে, এটা অনিন্দিতার কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক ঠেকে। তনয়ের ওপর একক আধিপত্যে লামিয়াকে মাঝেমধ্যে অনিন্দিতার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয়। প্রথম প্রথম চুপচাপ মেনে নিলেও শেষটায় আর মেনে নিতে পারল না অনিন্দিতা; বরং একদিন তনয়কে বলেই ফেলল, ‘লামিয়ার প্রতি এই আদিখ্যেতাগুলো প্লিজ বন্ধ করো!’
সেদিন প্রথম তনয় বুঝতে পারে, অনিন্দিতা লামিয়াকে মেনে নিতে পারছে না। অদ্ভুত একটা দ্বন্দ্বে পড়ে গেল তনয়। তার আসলে কী করা উচিত?
তনয় আর লামিয়ার বন্ধুত্ব নিয়ে ওপরের লেখাটা বানোয়াট কোনো গল্প নয়, বরং আমার খুব কাছের মানুষের গল্প। এ রকম অসংখ্য লামিয়া-তনয় আছে, যারা কোনো প্রেমের সম্পর্ক নয়, বরং একটা স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে প্রমাণ করে—একটা ছেলে আর মেয়ে অবশ্যই বন্ধু হতে পারে। ‘দ্য পাথওয়ে অব লাভ’ বইয়ের লেখিকা জুলি অরভেলের মতে, ‘অবশ্যই নারী-পুরুষ বন্ধু হতে পারে। এমনকি একজন ছেলে আর মেয়েবন্ধুর সঙ্গে বা একজন মেয়ে তার ছেলেবন্ধুর সঙ্গে জীবনের সবচেয়ে চমৎকার মুহূর্তগুলো কাটাতে পারেন।’
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আলী আহমেদের কাছে ‘ছেলেমেয়ে বন্ধু হতে পারে কি না’ এ প্রশ্ন করা হলে জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই হতে পারে। আমাদের সময়ে ছেলেমেয়েদের ও রকম সহজ সম্পর্ক ছিল না। তার পরও আমার বেশ ভালো কিছু মেয়েবন্ধু তৈরি হয়েছিল, যাদের সঙ্গে আমার এখনো একটা পারিবারিক সম্পর্ক আছে। এদের অনেকেই আমার স্ত্রীর ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, একটা নির্দিষ্ট সীমানা রক্ষা করে ছেলেমেয়েতে বন্ধুত্ব সম্ভব। আর সময় তো এখন অনেকটাই বদলে গেছে। এখন ছেলেমেয়েরা সমানভাবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, চাকরিক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের সমান অংশগ্রহণ—এর মধ্যে যদি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকে, তাহলে চলবে কী করে?’
জনাব আলী আহমেদের কথা নিতান্ত ভুল নয়। এখন সময়টা আসলেই অনেক বদলেছে। বদলেছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও। এখন ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারে মাঝেমধ্যেই আপনি দেখবেন, একটা ছেলে আর একটা মেয়ের ছবি। হয়তো প্রথমে আপনি ধারণা করে নিতে পারেন, এরা প্রেমিক-প্রেমিকা। কিন্তু পরক্ষণেই ক্যাপশনে লেখা দেখবেন, ‘প্রিয় বন্ধু, তুই থাকিস চোখের তারায়।’
হয়তো এদের দেখে ‘ছেলেমেয়ে বন্ধু হতে পারে না’—বহু যুগ থেকে আঁকড়ে ধরা বিশ্বাসটা নড়বড়েও হয়ে যেতে পারে। হয়তো আপনার মনে হবে, বন্ধুত্বের কোনো সীমারেখা নেই, বয়স নেই, গণ্ডি নেই; নেই কোনো বাধ্যবাধকতা। হয়তো আপনিই কোনো একদিন বলে বসবেন, ‘কে বলেছে ছেলেমেয়েতে বন্ধুত্ব হয় না, খু-উ-ব হয়।’
লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়