দূষণ রোধে ফ্যাশন ব্র্যান্ড

Looks like you've blocked notifications!

প্যারিসে সম্প্রতি জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বরে দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলেছে এই সম্মেলন। এই সময়ে বিশ্বনেতারা নানা আলোচনা করেছেন। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজেছেন। অনেক বিষয় নিয়ে চায়ের কাপে ঝড়ও উঠেছে। এই সম্মেলন চলাকালে বলা যায় তাক লাগিয়ে দিয়েছে জার্মান স্পোর্টসওয়্যার জায়ান্ট অ্যাডিডাস। তারা বাজারে এনেছে এক নতুন পণ্য মিডসোল থ্রিডি প্রিন্ট করা স্নিকারস। এই বস্তুটির দাম কত, কাদের জন্য তৈরি, বিশেষত্বই বা কী— এসব নিয়ে কৌতূহলী আমরা হতেই পারি। তবে কথা সেসব নয়। বরং অ্যাডিডাসের ক্যারিশমা অন্যত্র। তারা এই স্নিকারস তৈরি করেছে সমুদ্র বর্জ্য দিয়ে। অর্থাৎ সমুদ্রে ভাসমান যেসব প্লাস্টিক তা থেকেই তৈরি করা হয়েছে নতুন এই ফ্যাশনেবল স্নিকারস। এতে কোন সন্দেহ নেই এই উদ্ভাবনী  নৈপুণ্য সমুদ্র দূষণ রোধে বিরাট ভূমিকা রাখছে। এ ক্ষেত্রে অ্যাডিডাসকে সহায়তা দিচ্ছে মার্কিন এনজিও ‘পারলে অব দি ওশান’।

আমরা নানাভাবেই প্রকৃতির ওপর অবিচার করছি। এ সামগ্রিক চেহারা ভয়াবহ।  আমরা বুঝে, না বুঝে সংহারি হয়ে উঠছি বারে বারে। প্রকৃতিও তাই প্রতিশোধ নিচ্ছে ইদানীং। রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে সে। প্রকৃতিকে শান্ত করার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত পদক্ষেপ। বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি। প্যারিসে সদ্য শেষ হওয়া সম্মেলনে সেসবই উঠে এসেছে আলোচনার টেবিলে। একদিকে আমরা অনেকেই যেমন প্রকৃতিকে থোড়াই কেয়ার করছি, অন্যদিকে অনেক সচেতন মানুষই ভাবছে তাকে রক্ষার নানা দিক নিয়ে। খুঁজছে উপায়, চেষ্টা করছে উদ্ভাবনের। এই অ্যাডিডাসের নতুন স্নিকারস তারই প্রমাণ। সচেতন সৃজনশীলতার এটাই জ্বলন্ত উদাহরণ।

সমুদ্র দূষণরোধে বেশ অনেক দিন ধরেই কাজ করে আসছে ‘পারলে অব দি ওশান’। তারা বিশ্বব্যাপী সাগরের বিপন্ন ইকোসিস্টেম সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করছে। সাগর থেকে প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করছে। অ্যাডিডাস কাজ করেছে তাদের সঙ্গেই। তারা যে উদ্ভাবনী স্নিকারস তৈরি করেছে তার মূল উপাদানই হলো সাগরের প্লাস্টিক আর সাগরের পাতা জাল। এসব অবশ্যই সাগর দূষণের অনুঘটক। মাছ ও অন্যান্য জলজপ্রাণীর জন্য জীবন হন্তারক। থ্রিডি প্রিন্ট মিডসোলের এই স্নিকারের নাম দেওয়া হয়েছে ওশান প্লাস্টিক। উভয় প্রতিষ্ঠানেরই ধারণা এই প্রয়াস অবশ্যই নতুন মাত্রা সৃষ্টি করবে। দৃষ্টান্ত হবে অন্যদের জন্য। এমনকি সাগর দূষণ রোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।

বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণাপত্র ‘সায়েন্সে’ এ বছরের গোড়ার দিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর অন্তত ৮০ লাখ মেট্রিক টন প্লাস্টিক সাগরে ফেলা হয়ে থাকে। তবে এই পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকবে যদি এর বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে কোনো আন্দোলন গড়ে না ওঠে। আরো সমস্যা হলো দীর্ঘস্থায়িত্বের কারণে পেট্রলিয়াম-নির্ভর প্লাস্টিকই বেশি উৎপাদন করা হয়। যা বছরের পর বছর থাকে, নষ্ট হয় না। বিশেষজ্ঞরা প্লাস্টিককে অভিহিত করছেন ডিজাইনের ব্যর্থতা হিসেবে। কারণ এর সৃষ্টি আছে, ধ্বংস নেই। তাই পৃথিবীর জন্য, প্রকৃতির জন্য প্লাস্টিক যাতে সমূহ ক্ষতির কারণ না হয়ে ওঠে সে দিকেই এখন নজর বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক আর ডিজাইনারদের। তাঁরা প্লাস্টিককে পুনর্ব্যবহার উপযোগী করে তোলার দিকে নজর দিচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী এসব নিয়ে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা যেমন হচ্ছে, বাস্তবায়নের চেষ্টা যে একেবারে হচ্ছে না, তা নয়।

অন্যান্য শিল্পের দিকে না গিয়ে বরং ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে আপাতত আলোচনায় রাখা যেতে পারে। এখানে বলা যায় ‘র অব দি ওশানস’-এর কথা। এটাও ওই ‘পারলে অব দি ওশানের’ই একটি সহযোগী প্রকল্প। এদের সঙ্গে ডেনিম ব্র্যান্ড জি-স্টার এবং বায়োনিক ইয়ার্ন মিলে একটি নতুন পরিবেশবান্ধব ব্র্যান্ড তৈরি করেছে ফ্যাশন ডিজাইনার ফ্যারেল উইলিয়ামকে সঙ্গে নিয়ে। এরা প্লাস্টিক থেকে সুতা তৈরি করছে। আর সেই সুতা দিয়ে বোনা হচ্ছে ডেনিম। সেই ডেনিম দিয়েই হচ্ছে পরিবেশবান্ধব জিন্স। এই উদ্যোগ সত্যিকার অর্থেই প্রশংসিত এবং ফ্যাশন অনুরাগীদের কাছে কাঙ্ক্ষিতও।কারণ এই জিন্স পরার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখার গর্ব- যেকোনো ভোক্তাই অনুভব করবেন। এসব জিন্স খুব যে ব্যয়বহুল তাও কিন্তু নয়।

সাগর দূষণ রোধের ক্ষেত্রে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে চমৎকার অবস্থানে রয়েছে বলেই মনে করেন পারলে অব দি ওশানের প্রতিষ্ঠাতা সিরিল গাটশ। কারণ এখানে ফ্যাশনের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রকৃতি রক্ষার দায়িত্বও। শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ‘র অব দি ওশানস’ সারা বিশ্বের বিভিন্ন সমুদ্রের তটরেখা থেকে অন্তত ২০ লাখ প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করেছে। তবে এও পর্যাপ্ত নয়। বরং আরো জোরে শোরে নামার প্রয়োজন অনুভব করছেন গাটশ।

প্লাস্টিকের যেকোনো সামগ্রীই পরিবেশন দূষণ করছে, বিশেষ করে বলা যায় প্যাকেজিং মেটেরিয়ালের কথা। অন্যদিকে অনেকেই তলিয়ে দেখছেন না ইকমার্সের দূষণ সৃষ্টিকারী ভূমিকা। এখন বিশ্বজুড়েই প্রসারিত হচ্ছে ইকমার্স। বাংলাদেশেও এই বাণিজ্য বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ইকমার্সের মাধ্যমে যে পণ্য ভোক্তার হাতে পৌঁছায় সেগুলো কিন্তু পোড়া হয় প্লাস্টিকের মোড়কে। মার্কিন পরিবেশবাদী সংগঠন এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালে আমেরিকায় মোট কঠিন বর্জ্যের মধ্যে ৩০ শতাংশই ছিল কন্টেইনার আর প্যাকেজিং থেকে আসা। গেল বছর পণ্যের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত মোড়কের পেছনে ব্যয় হয় প্রায় ২২০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৬০০ কোটি ডলার ব্যয় হয় প্লাস্টিকের তৈরি প্যাকেটের পেছনে।

গাটশের পর্যবেক্ষণ, বর্তমানে পণ্য আসলে বার্তা। তাই আমাদের উচিত হবে নতুন একটা মান নির্ধারণ করা। আর উৎপাদক ও পরিবেশককে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া। এ প্রসঙ্গে তিনি অ্যাডিডাসের নতুন উদ্ভাবন ওশান প্লাস্টিক স্নিকারসকে উদাহরণ হিসেবে নিয়েছেন। এটা সম্ভব হয়েছে সৃষ্টিশীল মস্তিষ্কের জন্যই। ফলে তিনি বাহবা দিতে চান সৃজনশীল সমাজকে। যেহেতু তারাই পরিবর্তনের দিশারী। তাদের হাত ধরেন সেটা নিশ্চিত হবে।

এদিকে পারলে অবশ্য নতুন এক টেকসই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সংক্ষেপে বলা হচ্ছে এআইআর- অ্যাভয়েড, ইন্টারসেপ্ট, রিডিজাইন- এড়িয়ে চলুন, বাধা দিন, পুনর্নকশা করুন। তারা একটা গাইডলাইনও দিয়েছে, যেটা ফ্যাশন উদ্যোক্তা এবং ভোক্তারা অনুসরণ করতে পারেন। শুরু হতে পারে এভাবে- প্রতিদিনের কাজে প্লাস্টিক এড়িয়ে চলা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করা আর পুনর্নকশা বা পুনরুদ্ভাবনের মাধ্যমে সমাধান বের করা।

একেবারে প্রয়োজন ছাড়া প্রকৃতিকে দূষিত করে এমন সামগ্রী ব্যবহার থেকে বিরত থেকেই এগিয়ে যেতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে প্রয়োজনীয় বিকল্প। এভাবেই হয়তো দূষণ রোধের টেকসই সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও লাইফস্টাইল প্রফেশানাল

sksaifurrahman@gmail.com