ফ্যাশন শিল্প

উঠে আসছে মিয়ানমার

Looks like you've blocked notifications!

যেসব ঘটনা ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী আলোচনায় এসেছে তার মধ্যে একটি অবশ্যই মিয়ানমারের সাম্প্রতিক নির্বাচন এবং অং সান সু চির নির্বাচিত হওয়া। তাঁর দল ইতিমধ্যে সরকারও গঠন করেছে। সামরিক জান্তা গত্যন্তর না দেখে তাঁকে সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে।

এই মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী। তার চেয়েও বড় কথা দেশটি নানাভাবে আমাদের বহু পরিচিত। না গিয়েও আমরা এই দেশ সম্পর্কে জানি। একসময় এটাই ছিল বার্মা। আজ যেমন বাঙালি মধ্যপ্রাচ্যে যায় ভাগ্যান্বেষণে। যায় অন্য দেশে। একটা সময় ছিল যখন বাঙালি চাকরি, ব্যবসা, ওকালতির জন্য যেত বার্মায়। সেটা একটা জাতে ওঠার ব্যাপারও ছিল। দেশটির রাজধানী ইয়াঙ্গুনে (আগে বলা হতো রেঙ্গুন) এখনো বাঙালি পাড়া আছে।

বার্মা নিয়ে কথা বলতে গেলেই আরেকটি নাম আমাদের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আর তাঁর অমর চরিত্র শ্রীকান্ত। অর্থাৎ তিনি নিজে। তাঁর জাহাজে বার্মায় যাওয়া, ঝড়ের মুখে পড়া, এমনকি সেখানে থাকার অভিজ্ঞতা আজও বাঙালি পাঠককে অন্যরকম আনন্দ দেয়। 

পাঠক এখনো বোধহয় ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছেন না আমার লেখার বিষয়বস্তু। কিছুটা হয়তো দ্বেন্দ্ব পড়ে গিয়ে থাকবেন। না আজকের মিয়ানমারে সরকার গঠন বা পুরনো স্মৃতিচারণা নয়। বরং এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র এই দেশে ক্রমবর্ধমান বাজার আর তা ধরার ক্ষেত্রে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর আগ্রহ এই নিবন্ধের বিষয়। কত হতে পারে এই সংখ্যাটা? সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে ক্রয়সাধ্য রয়েছে এমন ভোক্তার সংখ্যা ৫০ লাখ।

রাজধানী ইয়াঙ্গুনে বাস করে অন্তত ৬০ লাখ। এটা সে দেশের বাণিজ্য নগরিও বটে। এখানে আলিশান প্রাসাদ যেমন আছে, আছে বস্তি, পৃথিবীর বেশির ভাগ বড় শহরের মতোই। একইভাবে আর্থিক বৈষম্যও অন্যান্য দেশের মতো রয়েছে এখানে। তাই নৈশ আসরে উজ্জ্বল বেশভূষায় যেমন দেখা যায় নরনারী তেমনি সাধারণ পোশাকের মানুষের চলমানতাও সেখানকার নৈমিত্তিক দৃশ্য।

ভূপ্রকৃতি আর আবহাওয়াগত দিক থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের বেশ মিল আছে। গরমের উপস্থিতি সেখানে আমাদের মতো। ফলে কী ধরনের পোশাক মূলত বাজার পেয়ে থাকে তাও অনুমিত। তবে ফ্যাশনের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের সঙ্গে অমিলটা হলো, এত দিন সামরিক জান্তার অধীনে থাকলেও, আমাদের সমান প্রবৃদ্ধি না থাকলেও, আমাদের মতো তৈরি পোশাক শিল্প আর চামড়া শিল্পের শনৈ শনৈ উন্নতি না থাকলেও সেখানে নিয়মিত ফ্যাশন উইক হয়। সেখানে স্থানীয় ডিজাইনার তাদের সৃষ্টি তুলে ধরেন। আন্তর্জাতিক বাজার উপযোগী যেসব হয় বা হচ্ছে তা নাহলেও সেখানে চেষ্টাটা লক্ষ্য করা যায়। তবে সামরিক সরকারের দীর্ঘ সময়ে তেমন কোনো নামি ব্র্যান্ডের উপস্থিতি সেখানে ছিল না। বরং সমাজে উঁচুতলার মানুষরা সিঙ্গাপুর, হংকং বা থাইল্যান্ড থেকে কিনে নিয়েছে নিজেদের পছন্দের ব্র্যান্ড।

ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির উল্লেখযোগ্য উত্থান দেখা যায় ১৯৯০-এর দশকে। তবে সামরিক জান্তার কারণে আমেরিকা আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় তারা পরবর্তী সময়ে সমস্যায় পড়ে। তবে নতুন গণতান্ত্রিক সরকারের আসায় তারা আবার যারপরনাই আশাবাদী হচ্ছে। অনেকেরই অভিমত আগামী কয়েক বছরেই মিয়ানমারের  ফ্যাশন মার্কেটে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হবে। অবশ্য অবস্থা শিথিল হওয়া শুরু হয় সামরিক সরকারের শেষ দিকে এসে। তারা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারে উদ্যোগী হলে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। নিয়মকানুনে বেশ পরিবর্তন আছে। এর ফলে প্রতিবেশী দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সেদেশে তাদের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেছে। বছর দুয়েক আগে মালয়েশিয়ার ডিপার্টমেন্ট স্টোর পার্কসন ইয়াঙ্গুনসহ অন্যান্য শহরে তাদের স্টোর করেছে। বর্তমানে সেখানে যেসব ফ্যাশন আর লাক্সারি যেসব ব্র্যান্ড আছে তার সবই থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর আর চীনের। তবে প্রশান্ত আর আটলান্টিক পারের কোন ব্র্যান্ড এখনো ঢোকেনি। অবশ্য আমাদের এখানেও কি ঢুকেছে? আশপাশের দেশের যেসব ব্র্যান্ড এখন সেখানে রয়েছে তাদের দেখা মেলে মূলত নগরীর কয়েকটি কেন্দ্রে- টাও উইন সেন্টার আর জাংশান স্কোয়ার বা ড্রাগন সেন্টার।

মিয়ানমারের এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে জান্তা সরকারের শেষদিককার সংস্কারের ফলে আমেরিকা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ তাদের মিত্ররা অবরোধ আরোপ প্রত্যাহার করে। আর এখন তো বিনিয়োগের জন্য সবার নজর বার্মার দিকে। গত বছর তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮.৫ শতাংশ। যা বিশ্বে ষষ্ঠ। আভাস রয়েছে আগামী দুই বছরে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।

অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক এখনো কিছুটা দোটানায় রয়েছে বলেই উদ্যোক্তাদের সমস্যা হচ্ছে। তা সত্ত্বে অনেক ফ্যাশন এন্টরপ্রেনর স্থানীয় ব্র্যান্ড ছাড়াও সেদেশের অভিজাতদের চাহিদা মেটাতে মেরি ক্যাটরানঝাও, কারভেন, থ্রি পয়েন্ট ওয়ান ফিলিপ লিম এবং ফিলিপ কার্কউডের মতো ব্র্যান্ড পোশাক সেখানে বিক্রি করছে।

ইয়াঙ্গুন বা সেই রেঙ্গুন এখন আর সেখানকার রাজধানী নয়। বরং নেইপাইদাও বর্তমানে রাজধানী। এই দুটো শহর ছাড়া মান্ডালায় নামের আরেকটি শহরেই মূলত অভিজাত আর বিত্তশালীদের বসবাস। এরাই আসলে বিলাসী পণ্যের মূল ভোক্তা। তবে গণতন্ত্রের সুবাতাসে আশা করা হচ্ছে সেদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসবে। আর মানুষে ক্রয়সামর্থ্য বৃদ্ধির ফলে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির পালেও বাতাস লাগবে। অবশ্য সেজন্য কয়েকটা বছর তাদের অপেক্ষা করতে হবে। এখন সময়টাকে একেবারে সূচনা হিসেবে ধরা হলেও ব্র্যান্ডগুলো এই বাজারকে কীভাবে এক্সপ্লোর করবে তার রূপরেখা এখনই নির্ধারণ করে ফেলা প্রয়োজন বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিমধ্যে বিভিন্ন শহরে বড় বড় মল নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে।

এদিকে ইয়াঙ্গুনে বড়লোকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এই সংখ্যাটা আগামী বছরগুলোতে আরো বাড়বে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। একইভাবে আশা করা হচ্ছে সেখানে দরিদ্রের সংখ্যাও কমবে। ইতিমধ্যে প্রচুর বিনিয়োগ বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন খাতে আসা শুরু হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী এই দেশ গত বছর ২০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। যা এর আগে দুই বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সস্তাশ্রম আর বর্তমানের উদার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে পরিমাণ আরো বাড়বে। এই অবস্থা আবার তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের জন্য আশঙ্কার কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।  এডিডাস, গ্যাপ, এইচঅ্যান্ডএমের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো মিয়ানমারে তাদের পণ্য উৎপাদন করাচ্ছে । বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন তৈরি পোশাক খাত সেই দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি গড়ে উঠবে তাদের স্থানীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। সেখানকার ফ্যাশন ডিজাইনাররা উঠে আসছেন। এই পজিটিভ পটবদল আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর উপস্থিতি ত্বরান্বিত করবে।

 

লেখক : সাংবাদিক, এটিএন নিউজ এবং লাইফস্টাইল প্রফেশনাল।

sksaifurrahman@gmail.com