সম্পর্কের রসায়ন
প্রেমের জন্ম সেই আদিকাল থেকেই। মানব জন্মের ইতিহাস আর প্রেমের ইতিহাস একইসূত্রে গাঁথা। পৃথিবীর প্রথম নর-নারী আদম-হাওয়া বা এডাম-ঈভ পরস্পরের প্রেমে পড়েছিলেন। এ কারণে ঈশ্বরের নিষেধ উপেক্ষা করে আদম তাঁর সঙ্গিনী ঈভের অনুরোধ রক্ষা করেছেন। গন্ধর্ব ফল প্রেমে অন্ধ হওয়ার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পৃথিবীর এই আদি পিতা। এই প্রেম যেমন সত্য তেমন শাশ্বত।
ভারতীয় পুরাণে শ্রীরামচন্দ্রের পতিব্রতা স্ত্রী সীতার প্রেমে পড়েছিলেন রাবণ। এজন্য তিনি সীতাকে অপহরণ করে অশোক কাননে বন্দি রেখে দেহ-মনে পাবার সব কলাকৌশল অবলম্বন করেছিলেন।
রাবণের প্রেম ছিল একতরফা বলপ্রয়োগ করে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, তাই এই প্রেম আদম-হাওয়ার মতো পবিত্র নয়। অপূর্ব সুন্দরী হেলেনের প্রেমে পড়েছিল গ্রিক পুরাণের প্রেমিক-পুরুষ প্যারিস। হেলেন তখন রাজা মেনেলাসের স্ত্রী। তাই এই প্রেম তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় স্বীকৃত ছিল না। ফলে ধ্বংস হয়েছিল ট্রয় নগরী। একজন পুরুষ হয়ে পুরুষের প্রেমে পড়েছিলেন ইতিহাস-বিখ্যাত বীর আলেক্সজান্ডার দ্য গ্রেট। এই প্রেম ছিল নিষিদ্ধ। আজও পৃথিবীর বেশির ভাগ স্থানে তা সাধারণ-স্বীকৃতি পায়নি। পাপ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।
প্রেম শব্দটি এক হলেও পৃথিবীতে তার বিস্তার ঘটেছে এমন নানামুখী সম্পর্কের ভেতর দিয়ে। এর মধ্যে কোনো কোনো সম্পর্ক যুগে যুগে দিকে দিকে মানুষ শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করেছে। আবার কোনো কোনো সম্পর্ক পাপাচার আখ্যায়িত করে প্রেমের পাত্রপাত্রীকে চড়িয়েছেন শূলে।
সাধারণ প্রেম
এই ক্যাটাগরিতে আমরা সবচেয়ে বেশি দেখা প্রেমকে ফেলতে পারি। এই প্রেম দুজন বিবাহিত বা অবিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে ওঠে। পৃথিবীতে প্রায় সব সমাজে এই প্রেমকে শাশ্বত এবং পবিত্র বলে ধরে নেওয়া হয়। পৃথিবীতে শুধু ভালোবেসে অমর হয়েছে এমন সাহিত্য-পুরাণ ও বাস্তবজীবনের উল্লেখযোগ্য প্রেমিকজুটি হলো সাইকি-কিউপিড (গ্রিক); রাধা-কৃষ্ণ (ভারত উপমহাদেশ); লাইলী-মজনু (পারস্য); বেহুলা-লখিন্দর (বাংলাদেশ); প্যারিস-হেলেন (গ্রিক); রোমিও-জুলিয়েট (রোম); ওডিয়াস-পেনেলোপ (গ্রিক); পিরামাস-থিসবি (গ্রিক); পিগম্যালিয়ন-গ্যালাটিয়া (গ্রিক); দেবদাস-পার্বতী (ভারত); ভিক্টোরিয়া-আলবার্ট (ব্রিটেন) প্রমুখ।
পরকীয়া
পরকীয়া বলতে বোঝায় একজন নারী বা পুরুষের সঙ্গে একজন বিবাহিত নারী বা পুরুষের প্রেমের সম্পর্ক। অর্থাৎ পরস্ত্রী বা পরস্বামীর সঙ্গে প্রেম করা। এ ক্ষেত্রে প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনেই কিংবা যেকোনো একজন বিবাহিত হতে পারে। পৃথিবীর বেশির ভাগ সমাজকর্তৃক এই প্রেম স্বীকৃত নয়। তাই লোকচক্ষুর আড়ালে এই পরকীয়া হয়। হয়তো একটা পর্যায়ে সেটা মানুষ জেনে ফেলে। আর তখন প্রেমিক-প্রেমিকাকে ভর্ৎসনা করে সমাজ।
বর্তমান নাগরিক জীবনে পরকীয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সাহিত্য, পুরাণ ও অনেক বিখ্যাত মানুষদের জীবনে এই পরকীয়া এসেছে। যেমনÑ হেলেন ও প্যারিসের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেটা পরকীয়ার সম্পর্ক। পৃথিবীজুড়ে একসময় হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল মনিকা-ক্লিনটনের পরকীয়ার সম্পর্ক। একইভাবে মেরিলিন মনরো-জন এফ কেনেডি, ডায়ানা-হেউইট, চার্লস-ক্যামিলা, ক্লিওপেট্রা-মার্ক অ্যান্টনি, সত্যজিৎ রায়-মাধবী মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি পরকীয়ার ঘটনা। পুরাণে দেখা যায়, স্বামী থাকা সত্ত্বেও পরকীয়া করে বেরিয়েছেন সুন্দরের দেবি আফ্রোদিতি।
এ ছাড়া আছে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম। বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে কামনা করছে চন্দ্র। হরণ করেও নিয়ে যাচ্ছে। সপ্তর্ষির স্ত্রীদের কামনা করছে অগ্নিদেব। ভৃগুর স্ত্রী পুলোমাকে কামনা করছে রাক্ষস (তারও নাম পুলোমা)। বান্ধবী দেবযানীর স্বামী যযাতিকে কামনা করছে শর্মিষ্ঠা। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে পরকীয়ার বহু ঘটনা আছে। চোখের বালি, ঘরেবাইরে, গৃহদাহ, হাঁসুলীবাকের উপকথা, কবি, পদ্মানদীর মাঝি, পৌষ ফাগুনের পালা, প্রদোষে প্রাকৃতজন, পরাণের গহীনসহ বাংলা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত উপন্যাসে পরকীয়ার প্রসঙ্গ আছে।
প্লেটোনিক প্রেম
আমরা জানি প্রেমে শরীর থাকবেই। নারী-পুরুষের মাঝে জৈবিক কারণে হলেও শরীর চলে আসে। কিন্তু প্লেটোনিক প্রেম হলো শরীরবিহীন প্রেম। অর্থাৎ এই প্রেম শরীরী নয়, অশরীরী। এখানে দুই প্রেমিক এবং প্রেমিকার মাঝে কোনো যৌন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় না। এই শুদ্ধতম ভালোবাসায় কামনা বাসনার কোনো স্থান নেই। এ শব্দটির উৎপত্তি মূলত প্লেটোর ‘প্লেটোনিজম’ মতবাদ থেকে; যাতে বলা হয় এমন প্রকার ভালোবাসার কথা যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকা ভালোবাসা ডিভাইনিটির দিকে উঠে যাবে। শরীর নামক বস্তুটি থাকবে অনুপস্থিত। এমন নিষ্কাম প্রেম, যে প্রেম রাজাধিরাজের মতো দুই হাত ভরে শুধু দিয়ে যায়, নেয় না কিছুই। বাস্তবে নারী পুরুষের মাঝে এমন প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়া আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে।
সমকামীতা
নারীতে নারীতে বা পুরুষে পুরুষে যে সম্পর্ক এবং যৌনজীবন তাকে বলে সমকামিতা। একে আলাদা ভাবে গেইজম বা লেসবিয়ানিজমও বলা হয়। এই সম্পর্ক আদিকাল থেকেই হয়ে আসছে। এটাকে মানসিক বিকৃতি হিসেবে দেখা হলেও, বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই আকাঙ্ক্ষাও কোনো কোনো মানুষের জৈবিক চাহিদা থেকে তৈরি হয়। শুধু মানুষ নয়, জীবজগতের অন্য প্রাণীদের মাঝেও সমকাম আছে।
জীববিজ্ঞানী ব্রুস ব্যাগমিল তাঁর বায়োলজিক্যাল এক্সুবারেন্স : এনিমেল হোমোসেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড ন্যাচারাল ডাইভার্সিটি’ বইয়ে প্রায় পাঁচশো প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্বের উদাহরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।
ইসলাম ধর্মে সমকাম কঠিনতম গর্হিত কাজ। হাদিসে আছে, সমকামের কারণে লুত (আ.)-এর জাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য ধর্মেও একে পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে সমকামিতা বৈধ নয়।
তবে বিশ্বের বেশ কিছু দেশে সমকামী পুরুষে পুরুষে এবং নারীতে নারীতে বিয়ে বৈধ করা হয়েছে। অন্যান্য দেশে বৈধ না হলেও এটিকে আর পাপাচার হিসেবে গণ্য করা হয় না। মানুষ ধীরে ধীরে প্রস্তুত হয়ে উঠছে এ ধরনের সম্পর্ক গ্রহণ করার জন্য। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষ এই ধরনের সম্পর্কে জড়িয়েছেন। তাঁদের কয়েকজন হলেন বীর আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট, লেখক জেমস বালডুইন, সঙ্গীতশিল্পী এলটন জন, কিং জুলিয়াস সিজার, শিল্পী জর্জ মাইকেল প্রমুখ।
সমকামিতার উল্লেখ আছে বহু প্রাচীন সাহিত্যে। হোমারে বর্ণিত আকিলিস এবং পেট্রোক্লুসের সম্পর্ক, প্লেটোর সিম্পোজিয়ামে ফায়াডেরাস, পসানিয়াস, এগাথন, অ্যারিস্টোফেনেস, এরিক্সিমাচুসের নানা বক্তব্য এবং সক্রেটিসের সাথে আলকিবিয়াডসের প্লেটোনিক সম্পর্ককে বহু বিশেষজ্ঞ সমকামিতার দৃষ্টান্ত হিসেবে হাজির করেন। রেনেসাঁর সময় বহু খ্যাতনামা ইউরোপীয় শিল্পী যেমন, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং মাইকেলেঞ্জেলোর সমকাম প্রবণতার উল্লেখ আছে।
ভারতীয় সংস্কৃতিতেও সমকামিতার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন বিষ্ণুর মোহিনী অবতাররূপে ধরাধামে এসে শিবকে আকর্ষিত করার কাহিনী এর একটি দৃষ্টান্ত। বিষ্ণু (হরি) এবং শিবের (হর) মিলনের ফসল অয়াপ্পানকে হরিহরপুত্র নামেও সম্বোধন করা হয়। এ ছাড়া অষ্টাবক্র, শিখণ্ডি এবং বৃহন্নলার উদাহরণগুলো সমকামিতা এবং রূপান্তরকামিতার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে উঠে এসেছে।
ভার্চুয়াল প্রেম
প্রেমকোষে বর্তমান ইন্টারনেট যুগের নতুন সংযোজন হলো ভার্চুয়াল প্রেম। এই প্রেম দুজন নারী-পুরুষের মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, চ্যাটিং সফটওয়্যার, মোবাইল ফোন, মেসেঞ্জার প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। ভার্চুয়াল ভালোবাসায় ভৌগোলিক ব্যারিয়ার কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি একটি সুবিধা। তবে ভার্চুয়াল প্রেমে অসুবিধাও অনেক। এর ফলে প্রেমের নামে মানুষকে ঠকানোর সুযোগ থাকে বেশি। বিশেষ করে ভার্চুয়াল প্রেমে নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ওয়েবক্যাম ব্যবহার করে অনেক সময় মেয়েদের ব্ল্যাকমেইল করা হয়। তবে একেবারে যে সত্যিকারের ভালোবাসার সাক্ষাৎ ভার্চুয়াল জগতে মেলে না, তা নয়। যেমন বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ফেসবুকের মাধ্যমে শিশিরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। পরে তাঁরা বিয়ে করেন। এমন উদাহরণ বিশ্বে বহু আছে।