আমার টিভি জীবনের শুরুর গল্প
৩ জুলাই ২০০৩। একটি দিন নয়, আমার জীবনে একটি নতুন টিভি অধ্যায়ের দরজা খোলার দিন। সেই দিনের চিত্রটি যতটুকু স্মৃতিতে আছে, প্রথমে তা বলতে চাই। টেলিভিশনে কাজ করব, সেই চাওয়াটা আমাদের মধ্যে শুরু হয় বেসরকারি টেরিস্টেরিয়াল চ্যানেল একুশে যখন সদর্পে বুক ফুলিয়ে নানা অনুষ্ঠান ও খবরের ডালি সাজিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে একটা অন্যরকম আনন্দের জায়গা তৈরি করল, সেই দিনগুলো থেকে। আমাদের চোখের সামনে তখন দুটি টেলিভিশনের বড় বড় প্রযোজকদের বা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নির্মাতাদের ছবি ভাসে। তাদের মধ্যে বিটিভি বা বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রখ্যাত প্রযোজক ও নাট্যনির্মাতা আবদুল্লাহ আল মামুন, মুস্তাফা মনোয়ার, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, আতিকুল হক চৌধুরী, নওয়াজীশ আলী খান, আল মনসুর, মুস্তাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ, ম. হামিদ, আলী ইমামরা ছিলেন সর্বাগ্রে। তারপর একুশে টেলিভিশনের মেধাবী প্রযোজকদের মধ্যে ফুয়াদ চৌধুরী, শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম, আ কা রেজা গালিব, আহীর আলম, পারভেজ চৌধুরী, মিনহাজুর রহমানরা তখন অনুষ্ঠান নির্মাণ ও বৈচিত্র্যময় কনটেন্টের অনুষ্ঠান উপহার দিয়ে টেলিভিশন মিডিয়ায় এক-একজন অনুষ্ঠান নির্মাতার আইডলে পরিণত হয়েছেন। তো আমরাও সেই স্বনামধন্য নির্মাতাদের আদর্শ বুকে ধারণ করে টেলিভিশনে নতুন কিছু উপহার দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
যা-ই হোক, সুযোগ হলো এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে একসাথে পথচলার। পরিচিত হলাম বিশিষ্ট টিভিব্যক্তিত্ব, এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান ও অনুষ্ঠান উপদেষ্টা শ্রদ্ধেয় মোস্তফা কামাল সৈয়দের সঙ্গে। উনার প্রসঙ্গে একটু বলি, কামাল ভাই নামে ডাকতাম আমরা। কামাল ভাই ছিলেন বরাবরই আমাদের মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়া হিসেবে। তারপর পরিচয় হয় মোহাম্মদ মুজাক্কের ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি ‘কিছু কথা কিছু গান’, ‘ভালোবাসো মোর গান’ প্রযোজনা করে প্রচুর সুনাম কুড়ান। অত্যন্ত সদালাপী মানুষ ছিলেন বিশিষ্ট গীতিকার ও প্রযোজক মোহাম্মদ মুজাক্কের। মুজাক্কের ভাই হিসেবে তিনি বেশি আপন ছিলেন। এরপর প্রোগ্রাম ম্যানেজার ছিলেন মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। আমরা আলম ভাই ডাকতাম। যদিও তিনি বয়সে আমার চাইতে ছোট ছিলেন। এরপর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার ছিলেন রিয়াজ মাহমুদ জুয়েল ভাই। তিনি অত্যন্ত সদালাপী এবং আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। জুয়েল ভাই আবৃত্তি এবং অভিনয় দুটোতেই খুব ভালো ছিলেন। শ্রদ্ধেয় মোস্তফা কামাল সৈয়দ ছিলেন আমাদের অনুষ্ঠান বিভাগের পিতা। আর আমরা সবাই ছিলাম সন্তানতুল্য শিষ্য। আমাদের প্রযোজকদের দলপ্রধান ছিলেন নির্বাহী প্রযোজক পারভেজ চৌধুরী। পারভেজ ভাই ছিলেন একজন কমিউনিস্ট ভাবধারার ভালো মানুষ। তবে আমাদের অনুজদের সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে উনি একটু উদাসীন টাইপের ছিলেন। তিনি বলতেন, আগে কাজ করে যান, সম্মানী বা বেতন নিয়ে তেমন মাথা ঘামাবেন না।
আমরা যখন এনটিভিতে কাজ শুরু করি ২০০৩ সালে, সেই সময় যে মাসোহারা পেতাম, তা বলার মতো নয়। কোন রকমে মাস চলে যেত। তো আমাদের প্রযোজকদলে ছিলাম আমি স্বীকৃতি প্রসাদ বড়ুয়া, জাহাঙ্গীর চৌধুরী, দীপু মাহমুদ, আলমগীর হোসেন, নাজমুল হুদা শাপলা, আলফ্রেড খোকন, তানভীর খান, মামুনুর রশীদ খান, আনোয়ার শাহাদাত খান, মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, ওয়াহিদুল ইসলাম শুভ্র, রফিক সংক্ষেপ। পরবর্তী সময়ে যোগ দেন হাসান ইউসুফ খান, জোনায়েদ বিন জিয়া, কাজী মোস্তফা, মৃণাল দত্ত ও হুমায়ূন ফরিদেরা। আর রুহুল তাপস ছিলেন পারভেজ চৌধুরী থেকে শুরু করে আমার, জাহাঙ্গীর ও আলফ্রেড খোকনের বান্ধা অনুষ্ঠান গবেষক ও সহকারী প্রযোজক।
২০০৩-এর শুরুতেই এনটিভির সান্ধ্য অনুষ্ঠান ‘শুভসন্ধ্যা’ ও ‘আজকের সকাল’ বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সেই সময় সান্ধ্য অনুষ্ঠান শুভসন্ধ্যা কনটেন্ট, সেট ও গালগপ্পো এই বিষয়গুলোর জন্য বেশি জনপ্রিয়তা পায়। তখন এই সকাল ও সন্ধ্যার এই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন পারভেজ চৌধুরী। শুভসন্ধ্যা প্রযোজনা করতাম আমি আর আজকের সকাল প্রযোজনা করত জাহাঙ্গীর চৌধুরী। সম্ভবত শুভসন্ধ্যা অনুষ্ঠানে প্রথম দিনের স্ক্রিপ্টটার একটা নমুনা লিখেছিলেন তখনকার এনটিভির সংবাদ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের সোহেল হক ও সুজন কবির। তৃতীয় দিন থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন শুভসন্ধ্যার স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম আমি। মনে আছে, প্রথম দিন শুভসন্ধ্যার অন-এয়ার ধরাতে একটু লেট হয়েছিল। কারণ, সেই সময় এনটিভির ভিডিও এডিটিং বিভাগ তেমন সুশৃঙ্খল ছিল না। আমার মনে হয়েছিল একটা বাজারের মধ্যে বসে আমরা অনুষ্ঠান নির্মাণ করছি। তবে প্রত্যেকের আন্তরিকতা ছিল অসাধারণ ভ্রাতৃত্বসুলভ। তখন শুভসন্ধ্যার উপস্থাপক টিমে ছিলেন জনপ্রিয় ও প্রতিভাবান উপস্থাপক মেহজাদ গালিব টুম্পা, টিনা সালেম মঞ্জুর ও প্রেমাঞ্জিতা চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে সেই উপস্থাপক টিমে যোগ দেন কাজী জেসিন, ফারহা শারমিন, ফারহানা নিশো, শম্পা, তাওফিকা রহমান, তুহিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, নুসরাত বিনতে রাব্বানি, কাজী রওশন আরা সাকী, তানিয়া অপরাজিতাসহ অনেকে। প্রথম দিন শুভসন্ধ্যার উপস্থাপক ছিলেন মেহজাদ গালিক টুম্পা, আর গালগপ্পো পর্বে অতিথি ছিলেন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী ও মডেল অপি করিম। আমরা নতুন প্রজন্মের কাউকে দিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলাম শুভসন্ধ্যার গালগপ্পো পর্বটি। আর অনুষ্ঠানটি এডিটিং করেছিলেন সেই সময়ের এনটিভির সিনিয়র ভিডিও এডিটর কামরুল হাসান। প্রযোজক ছিলেন পারভেজ চৌধুরী আর সহকারী প্রযোজক ছিলাম আমি। প্রতিদিনের এই শুভসন্ধ্যা অনুষ্ঠানটি আমি প্রায় ৩০০০ পর্ব প্রযোজনা করেছি। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার পরিচিতি ঘটে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা মাধ্যমের বিদগ্ধজনদের সাথে। সেই সময় বাংলাদেশের থিয়েটার, নাটক, আবৃত্তি, নৃত্যের ছিল স্বর্ণযুগ। অনেক যুগস্রষ্টা শিল্পী-সাহিত্যিক-কবিদের সম্মিলনে বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গন আসলেই সমৃদ্ধ ছিল। যাঁদের আমরা শুভসন্ধ্যায় অতিথি করে এনেছিলাম, তাঁদের কিছু তালিকা আমি এখানে যুক্ত করতে চাই এখনকার বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা দেওয়ার জন্য। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম বা আগে কী সুন্দর অনুষ্ঠান বানাইতাম...
আমরা শুভসন্ধ্যায় অতিথি হিসেবে পেয়েছি চলচ্চিত্র জগতের নায়করাজ রাজ্জাক, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলমগীর, রিয়াজ, ফেরদৌস, পূর্ণিমা, মৌসুমী, পপি, মিশা সওদাগরসহ অনেককে। থিয়েটার ব্যক্তিত্বদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, আতাউর রহমান, সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, শিমূল ইউসুফ, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, জাহিদ হাসান, তৌকীর আহমেদ, ঝুনা চৌধুরীসহ নব্য যত থিয়েটারকর্মী আছেন, সবাইকে আমরা একে একে শুভসন্ধ্যায় নিয়ে আসি।
ব্যান্ডশিল্পীদের মধ্যে আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, শাফিন আহমেদ, হামিন আহমেদ, তপন চৌধুরী, পার্থ বড়ুয়া, নকিব খানসহ নতুন যত ব্যান্ডশিল্পী ছিলেন সবাইকে আমরা একে একে নিয়ে আসি। সংগীতশিল্পীদের মধ্যে কলিম শরাফী, সোহরাব হোসেন, ফেরদৌসী রহমান, ফিরোজা বেগম, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, তপন মাহমুদ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সাদী মহম্মদ, অদিতি মহসিন, সুজিত মোস্তফা, ইয়াসমীন মুশতারী, শবনম মুশতারী, ফেরদৌস আরা, কাদেরী কিবরিয়া, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, ফকির আলমগীর, রামকানাই দাশ, ফরিদা পারভীন, কিরণ চন্দ্র রায় থেকে শুরু করে আসিফ আকবর, মনির খান, পলাশ, রিজিয়া পারভীনসহ নতুন প্রজন্মের প্রায় সব সংগীতশিল্পী।
টিভি নাটকের হুমায়ুন ফরিদী, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফা, ডলি জহুর, আসাদুজ্জামান নূর থেকে শুরু করে একে একে অন্যান্যদের আমরা অতিথি হিসেবে নিয়ে আসি। ওপার বাংলার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, রাজা সেন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত, গৌতম ঘোষসহ অনেক বিদগ্ধজনদের আমরা শুভসন্ধ্যায় নিয়ে আসি।
কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী, কবি নির্মলেন্দু গুণ, আনিসুল হক, সেলিনা হোসেন, ইমদাদুল হক মিলন, মহাদেব সাহা, সমুদ্র গুপ্ত থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের সকল কবি-সাহিত্যিক। চিত্রশিল্পীদের মধ্যে রফিকুন নবী, হাশেম খান, কাজী গিয়াস থেকে নতুন প্রজন্মের সকল চিত্রশিল্পীদেরও আমরা একে একে অনুষ্ঠানে অতিথি করে নিয়ে আসি। জুয়েল আইচ, নাসির আলী মামুন, বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকদেরও আমরা অতিথি করে নিয়ে আসি। নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে শামীম আরা নিপা, শিবলী মহম্মদ, শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় ,তারিন থেকে সকল নতুন প্রজন্মের নৃত্যশিল্পীদের আমরা অনুষ্ঠানে নিয়ে আসি।
চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলামসহ অনেক নির্মাতাকে আমরা অতিথি হিসেবে নিয়ে আসি। তো এনটিভির শুভসন্ধ্যা হলো আসলে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের কথামালার আর্কাইভ। সংস্কৃতির নানা মাধ্যমের এত গুণীজনকে আর কোনও টেলিভিশন আনতে পারেনি। পারবেও না। কারণ, গুণীজনেরা তো আর বেঁচে নেই এই ধরাধামে। তবে তাঁরা এনটিভির শুভসন্ধ্যার আর্কাইভ টেপে এখনও জীবন্ত আছেন। ভবিষ্যতের সংস্কৃতি গবেষকেরা এখানে পাবেন বিশাল কথামালার খনি।
আমি শুভসন্ধ্যা ছাড়াও অনেক অনুষ্ঠান প্রযোজনা করি। আমাদের শুভসন্ধ্যা থেকে শুরু করে সব অনুষ্ঠানের টিম ওয়ার্ক ছিল অসাধারণ। আর টেকনিক্যাল পারসন থেকে শুরু করে আর্কাইভ, ব্রডকাস্ট, ম্যানেজমেন্ট সবার ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সৌহার্দ্য, যা এখন এই মুহূর্তে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে বিরল। এনটিভি এগিয়ে গেছে এই টিমওয়ার্ক ও ভালো ব্যবস্থাপনার জন্য। ১৯ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে প্রত্যাশা, এনটিভির আগামী দিনগুলো হোক আরও বেশি সমৃদ্ধ ও সুন্দর। আমরা এনটিভি পরিবারে অনেক সদস্য ছিলাম। অনেকের নাম এই সংক্ষিপ্ত সময়ে উল্লেখ করতে পারিনি। অনেক মজার ঘটনাও এক মুহূর্তে লেখা সম্ভব নয়। তবে যত দিন এনটিভিতে ছিলাম, সেই দিনগুলো ছিল আমার গণমাধ্যম জীবনের মধুর সময়। সবার জন্য শুভকামনা। ‘সময়ের সাথে আগামীর পথে’ এগিয়ে যাক এনটিভি।
লেখক : সিনিয়র প্রযোজক, মাছরাঙা টেলিভিশন