এনটিভিতে আমার যাত্রা ও কার্ডিফে বাংলাদেশের সেই ঐতিহাসিক জয়
এনটিভির কথা মনে হলে প্রথম যে কথাটা আমার মাথায় আসে, তা হলো ‘কৃতজ্ঞতা’। ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের আদেশে বন্ধ হয়ে গেল তুমুল জনপ্রিয় দেশের প্রথম ও শেষ টেরেস্টোরিয়াল বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘একুশে টিভি’। অবশ্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল কয়েক মাস আগেই। বিয়ে করেছি, বাবাও হয়েছি—এরই মধ্যে এই ঘটনায় চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলাম! ২০০২ সালে দেশে এখনকার মতো ৪০-৪৫টা বেসরকারি টিভি চ্যানেল ছিল না। যা-ও একটা ছিল, তাঁরাও আকারে-ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন, একুশে টিভির ‘হাই স্যালারি’র লোকজন তাঁরা নিতে পারবেন না, পারলে তাঁদের মতো করে অল্প কয়েক জনকে জায়গা দিতে পারেন! অবস্থা বেগতিক দেখে, আমি বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম। একটাই আফসোস হচ্ছিল, আমার ছেলেটা কীভাবে বড় হচ্ছে, আমি তা দেখতে পাব না
এ রকম কঠিন সময়ে শুচি ভাই (হাসনাইন খুরশেদ, এনটিভির প্রথম নির্বাহী পরিচালক) বললেন, বিদেশে যাওয়ার চিন্তা বাদ দাও, নতুন একটা চ্যানেল আসছে। আশায় বুক বাঁধলাম। একুশে টিভি বন্ধ হওয়ার ১৫ দিনের মাথায় আমাকে প্রযোজক হিসেবে নিয়োগ দিল এনটিভি। আসলে ব্যবসায়িক দিক থেকে খুব সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এনটিভি, বিবিসির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেশের প্রথম প্রজন্মের বেশির ভাগ টিভি সাংবাদিক-টেকনিশিয়ানদের বেতন এক টাকাও না কমিয়ে বরং কমপক্ষে ৫০০ টাকা হলেও বাড়িয়ে নিয়েছিলেন তাঁরা। তার ফলও তাঁরা পান হাতেনাতে।
আমার মনে আছে, এনটিভির প্রথম সংবাদ প্রচারের কথা। ঠিক হলো ২০০৩ সালের ৩ জুলাই এনটিভির উদ্বোধন হবে। আগের দিন নিউজরুমে এক সম্মিলিত সভায় আমরা সবাই একমত হলাম, প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে আমরা যে অবস্থায় আছি, তাতে করে উদ্বোধনী দিনে সংবাদ প্রচার করলে ‘একুশে স্ট্যান্ডার্ড’ বজায় রাখা সম্ভব হবে না। কিন্তু মিটিং শেষ করে বাসায় যেতে না যেতেই ফোন, পরদিন সকাল-সকাল অফিসে যেতে হবে। কারণ, চেয়ারম্যান সাহেব (আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী) নিউজ ছাড়া এনটিভির উদ্বোধন কোনও ভাবেই মেনে নেবেন না! আমার মনে আছে, স্টুডিওতে শামসুদ্দীন হায়দার ডালিম (এনটিভির প্রথম নির্বাহী প্রযোজক, সংবাদ উপস্থাপক) নিউজরুমকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে তৈরি করা এনটিভির সেটে বসে কয়েকটি সংবাদের লিংক পড়ছেন, আমরা তা রেকর্ড করেই ছুটছি এডিটিং প্যানেলে; সেই লিংক রিপোর্টের সাথে যোগ করে একটা অংশ ডিভি টেপে নিয়ে ছুটছি পিসিআরে। এ ভাবেই কয়েকটি টেপে ভাগ করে প্রচার হলো এনটিভির প্রথম সংবাদ।
এনটিভিতে আমার দায়িত্ব ছিল নিয়মিত সংবাদ প্রযোজনার পাশাপাশি ‘গ্যালারি’ আর ‘স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড’ নামে দেশীয় ক্রীড়াঙ্গন আর আন্তর্জাতিক খেলাধুলার দুটি অনুষ্ঠান প্রযোজনার।
আমি বিটিভির অতিথি প্রযোজক থাকার সময় থেকেই টুকটাক স্পোর্টস রিপোর্টিং করি, একুশে টিভিতেও তা অব্যাহত ছিল। এনটিভিতে এসে পুরোদস্তুর ক্রীড়া সাংবাদিকতার সাথে জড়িয়ে গেলাম। সাইফুর রহমান খোকনের নেতৃত্বে নাসিমুল হাসান দোদুল, পরাগ আরমানকে নিয়ে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে এই দলে যোগ দিলেন খাইরুল আমিন, আবু সাদাতের মতো চৌকস স্পোর্টস রিপোর্টাররা। তবে এই ক্রীড়া সাংবাদিকতার সুবাদেই আমি ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইংল্যান্ড সফর কাভার করার সুযোগ পাই। সেই সফরে আমি একাধারে প্রডিউসার, স্পোর্টস রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান এবং ভিডিও এডিটর। আমার মনে আছে আমাদের ওপর কড়া নির্দেশ ছিল—যেভাবেই হোক ‘এনটিভির সবুজ-সাদা বুম’ যেন প্রিম্যাচ-পোস্ট ম্যাচের যেকোনও প্রেস কনফারেন্সে দেখা যায়। এমনও হয়েছে প্রেস কনফারেন্স হচ্ছে বড় একটা হলে, আমরা জায়গা পেয়েছি শেষ দিকে... অথচ আমাদের অডিও কেবল ছোট, পুরো হল কাভার করছে না! কী আর করা, বুমটা পডিয়ামে রেখে কেবল যতটা আসে নিচে ফেলেই দূরে ক্যামেরা ট্রাইপডে রেখে দাঁড়িয়ে গেছি। কারণ, আমি নিশ্চিত রয়টার্স, এপিটিএন কোনও না কোনও এজেন্সি এই প্রেস কনফারেন্স অবশ্যই কাভার করবে, অডিও-ভিডিও সেখানে পাবই। আমাদের উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এনটিভিকে পরিচিত করা। আরেকটা মজার অভিজ্ঞতা ছিল, তখন বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গতি বড়ই স্লথ! আমরা হিসাব করে দেখলাম, ৩০ শব্দের মধ্যে পিটিসি (রিপোর্ট শেষ করার আগে রিপোর্টারের ভাষ্য) দিলে তার আয়তন হয় ৫ মেগাবাইট, যা ই-মেইল করা সম্ভব। তাই আমরা ছোট হলেও বাধ্য হয়েই তা করতাম। হয়তো দোদুল রিপোর্ট করল, পিটিসি দিল, আমি পেন ড্রাইভ আর ল্যাপটপ নিয়ে ছুটলাম মাঠের কাছাকাছি কোনও সাইবার ক্যাফেতে (কারণ, প্রেসবক্সে ইন্টারনেট কানেকশন পেতে আগে থেকেই বুকিং দিতে হয় সেটা জানতাম না, আর নতুন ইন্টারনেট কানেকশন নেওয়া অনেক ঝক্কির, নিরাপত্তার কারণে বিদেশিদের দিতে চায় না বললেই হয়)। যা-ই হোক, সেই ঝামেলা সয়েই ওই সময় বিদেশ থেকে দিনের রিপোর্ট দিনে পাঠিয়ে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে ছোটখাটো বিপ্লব ঘটিয়ে দিল এনটিভি।
সিরিজের মাঝপথেই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় দোদুল দেশে ফিরে গেলে পুরো চাপ পড়ল আমার কাঁধে। তত দিনে বাংলাদেশ দুই টেস্ট ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের ত্রিদেশীয় ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ দলের ধারাবাহিক পরাজয়ে আমাদের মনোবলও তখন তলানিতে। এই সময় তখনকার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়ার সাথে প্রথম ম্যাচ ১৮ জুন, ২০০৫-এ ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফে।
নিশ্চিত পরাজয় জেনে আমরা ১৯ তারিখ লন্ডনের ফিরতি টিকেট কেটে জনকণ্ঠের স্পোর্টস এডিটর আরিফুর রহমান শিবলী আর আলোকচিত্রী মীর ফরিদের সাথে জুটি বেঁধে গেলাম সেখানে। গিয়েই ঐতিহাসিক সেই জয়ের সৌভাগ্যবান সাক্ষী হলাম আমরা। এখানে একটা মজার কথা বলি, ম্যাচ জয়ের পর আমি তাড়াতাড়ি মাঠের মাঝে গিয়ে উৎফুল্ল জনতাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ৩০ শব্দের দারুণ একটা পিটিসি দিলাম। দিয়ে পিটিসির অডিও-ভিডিও ঠিক আছে কি না, তা দেখতে ডিভি টেপটা আবার রিওয়াইন্ড করে দেখলাম... একটু সন্দেহ হওয়ায় আবার যখন রিওয়াইন্ড করেছি, তখনই একদল সিলেটি প্রবাসী ভাই ‘আমরা মাতমু... আমরা মাতমু’ বলে ভিড় করলেন। আমি মনে করলাম মন্দ কি, দেশের জয়ে উৎফুল্ল প্রবাসীদের ভক্সপপ নেওয়াই যায়, নিয়ে ফেললাম। পরে প্রেসবক্সে এডিট করতে গিয়ে দেখি আমার সেই চমৎকার পিটিসি আর নেই! আঁতিপাতি করে পিটিসি খুঁজে না পেয়ে যখন দিশেহারা, তখন হঠাৎ মনে হলো সিলেটি ভাইদের ভক্সপপ নিতে গিয়ে আমার চমৎকার পিটিসিটা ইরেজ হয়ে গেছে! তখন মাঠও ফাঁকা হয়ে গেছে... কী আর করা, প্রেসবক্সের ছাদে গিয়ে বিরস বদনে আরেকটি পিটিসি দিলাম।
এরপর এনটিভি দেশের স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে প্রথম নিয়ে এলো স্যাটেলাইট নিউজ গ্যাদারিং (এসএনজি) ইকুইপমেন্ট। মানে দেশের যেকোনও জায়গা থেকে স্যাটেলাইট বুকিং দিয়ে লাইভ করার সুবিধা। এই প্রযুক্তিতে সিলেটে শায়খ আব্দুর রহমান গ্রেপ্তারের ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করে পুরো দেশে আলোড়ন ফেলে দিল এনটিভি।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের অধিনায়ক জিনেদিন জিদানের বাংলাদেশ আগমনও বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সম্প্রচার করেছিলাম আমরা।
এভাবে সময় যতই গড়িয়েছে, এনটিভিও এগিয়েছে... সময়ের সাথে আগামীর পথে।