ট্রাম্পের রাজনীতির শেষ পরিণতি!
অবশেষে ট্রাম্পকে ক্ষমতা ছাড়তে হচ্ছে। ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসিত হওয়ার বিষয়টি এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো প্রেসিডেন্ট দুবার অভিশংসিত হলেন। তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে অনুমান করা যায়, তাঁর ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়ে আসলেও তিনি এখনো আশা ছাড়েননি।
এ জন্য তিনি নানা ধরনের সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে চলেছেন। ২০ জানুয়ারি নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে না পারলে তিনি ক্ষমতায় থেকে যাবেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে অনির্দিষ্টকাল হোয়াইট হাউসে থাকবেন, এটাই তাঁর এক ধরনের পরিকল্পনা ছিল। তবে তিনি এখনো ভাবছেন, বড় ধরনের সংঘাত সৃষ্টি করে বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণ বাধাগ্রস্ত করতে পারলে, বৈধভাবে না হোক, অবৈধভাবে ক্ষমতা চলে যেতে পারে সেনাবাহিনীর হাতে। সাময়িকভাবেও এই ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতে গেলে তাঁর সুবিধা হয়। মুসোলিনি যেমন মুষ্টিমেয় অনুচর নিয়ে রোমে শোভাযাত্রাসহ প্রবেশ করে দুর্বল গণতান্ত্রিক শাসক ভিক্টর ইমানুয়েলের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ইতালিতে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করতে পেরেছিলেন, তিনিও তেমনই আবার সমর্থকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে হোয়াইট হাউসে থাকতে পারবেন এবং আমেরিকায় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন, এমন প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছেন।
তবে ২০ জানুয়ারি জো বাইডেনের অভিষেকের সময় ট্রাম্প সমর্থকেরা যাতে বড় ধরনের গোলযোগ সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য সেনাবাহিনী কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মার্কিন গণতন্ত্র এখন সেনাবাহিনীর পাহারায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়ে গণতন্ত্র ধ্বংস করে সেনাশাসন প্রবর্তনের ইতিহাস যে আমেরিকার, সেই আমেরিকার গণতন্ত্র এখন সেনা পাহারায়। এখন আমরা ট্রাম্পের রাজনীতির শেষ পরিণতির অপেক্ষায়। তাঁর এই পরিণতির পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেগুলো মূলত ট্রাম্প নিজেই সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সময়েই যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের সহাবস্থান ও বসবাসে এক ধরনের অনৈক্য ও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যে ট্রাম্পের বিভাজনের রাজনীতি, মানুষের মধ্যে ভেদাভেদের বর্ণবাদ নীতি এবং গণতন্ত্র পরিপন্থি শাসনব্যবস্থা মেনে নেয়নি, তা বাইডেনকে নির্বাচিত করে বুঝিয়ে দিয়েছে। তিনি শ্বেতাঙ্গদের উসকে দিয়েছিলেন। অভিবাসী নীতি কঠোর করে তা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।
তাঁর কর্মকাণ্ডে এক ধরনের ‘পাগলামি’ প্রকাশিত হতে থাকে ২০১৬ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই। অবশ্য তিনি প্রথমবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েই বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করে সমালোচিত হয়েছিলেন। সে সময় উল্টাপাল্টা বক্তব্যের কারণে বিশ্লেষকেরা তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথাও বলেছিলেন। তার পরও আমেরিকানেরা তাঁকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। যদিও তাঁর নির্বাচিত হওয়ার পেছনে তখন রাশিয়ার কানেকশন ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হলেও তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা পড়েনি। নির্বাচিত হয়েই তিনি একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোতে আঘাত হানতে থাকেন। সর্বশেষ গত বছর পুলিশ কর্তৃক এক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার জেরে বর্ণবিদ্বেষ এবং দাঙ্গা গোটা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ব্যাপক সহিংসতার সৃষ্টি হয়। এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে ছিল ট্রাম্পের উসকানিমূলক বক্তব্য ও সমর্থন। সূচনা হয় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের। বর্ণবাদী এই আন্দোলন দমাতে ট্রাম্পকে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী নামাতে হয়। নির্বাচনে জেতার জন্য ট্রাম্প হেন কোনো পন্থা নেই, যা অবলম্বন করেননি। পরাজিত হওয়ার পর তিনি আরো উন্মাতাল হয়ে পড়েন, অনেকটা ভারসাম্যহীন আচরণ করতে শুরু করেন।
নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, ফল উল্টে দেওয়া হয়েছে, ইত্যাদিসহ নানা অভিযোগ করতে থাকেন। এ নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আদালতে মামলা পর্যন্ত করেন। এসব মামলায় তিনি হেরে যান। তাঁর সব আশার প্রদীপ যখন একে একে নিভে যায়, তখন ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার সর্বশেষ অস্ত্র হিসেবে তিনি সহিংস পন্থা অবলম্বন করেন। তাঁর উগ্র সমর্থকদের দিয়ে গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলের কংগ্রেস ভবনে হামলা চালান। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ২০৬ বছর পর ক্যাপিটল হিলে হামলার এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা দ্বিতীয়বারের মতো ঘটে। ১৮১৪ সালে ইংরেজরা প্রথম এ ভবনে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ২০২১ সালে এসে হামলার সরাসরি ইন্ধন দেন যুক্তরাষ্ট্রেরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। হামলার দিন হোয়াইট হাউসের কাছে একটি সমাবেশে ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমরা ক্যাপিটল ভবনে পদযাত্রা করব। আমাদের সাহসী সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের উৎসাহিত করব। আপনাদের দৃঢ়তা দেখাতে হবে।’ তাঁর এ বক্তব্যের পর পরই হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থক ক্যাপিটল হিলের দিকে যাত্রা শুরু করে। সেখানে গিয়ে বিক্ষোভ এবং হামলা চালায়। এ হামলা ক্যাপিটল হিলে হয়নি, হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ওপর।
শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের ক্ষমতায় থাকার শেষ অস্ত্রটি ব্যর্থ হওয়ায় তিনি এখন শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। ক্ষমতার কয়েক দিন বাকি থাকতে তাঁকে ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি এবং ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর ক্ষমতার অপব্যবহারসহ অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন। ন্যক্কারজনক এ ঘটনা ঘটিয়ে এখন তিনি ক্ষমা পাওয়ার পথ খুঁজছেন। তিনি ক্ষমা পাবেন কি না, তা এখন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রমনস্ক রাজনীতি এবং নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়