পহেলা বৈশাখ ইতিহাসের, ঐতিহ্যের
‘ফসলি সন’ থেকে ‘বাংলা সন’। সনের প্রথম দিনটি ধীরে ধীরে হয়ে উঠল বাংলার ঐতিহ্যে। ইতিহাসজুড়ে বিছিয়ে নিল বিশাল অধ্যায়। হয়ে উঠল সব শ্রেণি-পেশা-বর্ণের মানুষের উৎসব। এখন তা বাংলার মানুষের কাছে সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে।
মুঘল সম্রাট আকবর প্রবর্তিত সৌরবর্ষ গণনার এই সনের শুরুতেই বৈশাখ। সেই বৈশাখ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি বাদেও প্রভাব বিস্তার করে আছে ব্যবসানীতি, সমাজরীতিতে। বিতর্কিত হয়েছে বহুবার, তবু হাজার হাজার বছর ধরে স্থান করে নিয়েছে মানুষের মনে। তাই বৈশাখের প্রথম দিনটি বরণডালায় করে মাতিয়ে তোলেন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ; চারদিকে শোনা যায় আহ্বান, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়’, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’, ‘মেলায় যায় রে’।
শুধু কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, বাংলা সাহিত্যজুড়ে আছে বোশোখী হাজারও কবিতা, গীতিকবিতা, ছড়া, পদ্য, প্রবন্ধ, গবেষণা। এ পর্যন্ত লেখায় পরোক্ষভাবে পহেলা বৈশাখের ছাপ আছে কতটিতে, তা গুণে শেষ করার বিষয়ে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান বলছে—‘অসম্ভব।’
কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায় ছুঁয়ে গেছে বৈশাখ, সেখানে আছে আহ্বান। অন্যদিকে, জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন ‘ঘুমিয়ে পড়ব’, ফররুখ আহমদ বললেন, ‘প্রচণ্ড সে গতিবেগ ভাঙে বস্তি,/বালাখানা, ভেঙে পড়ে জামশিদের জাক/লাভ-ক্ষতি সংজ্ঞাহীন, নিঃশঙ্ক, নিঃসঙ্গ তুমি/হে দুর্বার, দুর্জয় বৈশাখ।’
কবি আল মাহমুদ ‘বোশেখ’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘ধ্বংস যদি করবে তবে, শোনো তুফান/ধ্বংস করো বিভেদকারী পরগাছাদের/পরের শ্রমে গড়েছে যারা মস্ত দালান/বাড়তি তাদের বাহাদুরি গুঁড়িয়ে ফেলো।’ আর আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘পয়লা বৈশাখ ১৩৭৯’ শিরোনামে কবিতায় লিখেছেন, ‘আমার মনের মধ্যেও/নীল-কালো-সাদা-সোনালি-পাটল চলছে অনেক রঙের খেলা…’।
কবি আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতাগুলো মধ্যে বৈশাখ নিয়ে লেখা খুঁজে পাওয়া যায়, যা প্রসংশনীয়। তবে, কবি সমুদ্র গুপ্তের চোখে বৈশাখ অনন্য। যেখানে জেগে উঠেছে বাংলাদেশের ইতিহাস। ‘বৈশাখ : একাত্তরে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘যুদ্ধের প্রথম মাসে এসেছিল পয়লা বৈশাখ/মেঘের ডম্বরু ফেলে হাতে হাতে উঠেছিল।’
মাকসুদুল হকের লেখা ও সুরে জনপ্রিয় গান ‘মেলায় যাই রে’। খেয়াল করে শুনলেই বোঝা যায়, বৈশাখের অর্থনৈতিক গুরুত্ব। বাংলা নববর্ষ শুধু পোশাক কেনাকাটা আর পিঠা-পায়েশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, দিনটি সার্বজনীন বিধায় দিনদিন ঘটেছে এর বিস্তৃতি। কৃষির ও খাজনা ইত্যাদির হিসাব রাখার জন্য সৃষ্ট সৌর সনের প্রথম দিনটি এখন সার্বজনীন উৎসবের হওয়ায় এর কয়েক মাস আগ থেকেই ব্যবসায়ীদের বাড়ে ব্যস্ততা। ফুল, ফল, অলংকারশিল্প, আল্পনার জন্য রঙশিল্পও বাদ যায় না। খাবার, হেলথ কেয়ার আইটেম তো আছেই। আর নববর্ষকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মেলায় বেজে ওঠে—‘বছর ঘুরে এলো আরেক প্রভাতী/ফিরে এলো সুরের মঞ্জুরী/পলাশ শিমুল গাছে লেগেছে আগুন/এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি/মেলায় যাই রে, মেলায় যাই রে...’
কালের বিবর্তনে পহেলা বৈশাখে যুক্ত হয় পান্তা ইলিশ বা ইলিশ মাছ খাওয়ার প্রচলন। যদিও তা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে, সেটিও এদিন ঘিরে অর্থনৈতিক সঞ্চালন সৃষ্টি করে। অবশ্য নানা আলোচনা-সমালোচনায় এখন তা অনেকটাই নিভু নিভু। যদিও তার যতেষ্ট কারণও আছে। আপাতদৃষ্টিতে পান্তা-ইলিশের জায়গায় শক্ত স্থান গড়ে নিতে দেখা যাচ্ছে দেশীয় ঐতিহ্যের পিঠাপুলি।
দেশের প্রথম সারির একটি নিউজ পোর্টালে ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল প্রকাশিত এ বিষয়ক আলোচনা তুলে ধরেছেন মাকসুদা আজীজ। তিনি সেই সময়ের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সংস্থা ‘ঐতিহ্য অন্বেষণ’র সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক শারমিন রেজওয়ানার পহেলা বৈশাখে ইলিশ-পান্তা যোগ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘ইলিশ খাওয়ার এই ভুঁইফোড়া রীতি তৈরি হয়েছে খুব সম্প্রতি। রমনার বর্ষবরণ উৎসব এবং চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা জমে যাওয়ার পরে যখন এ এলাকা ঘিরে লোক সমাগম হতে থাকে। তখন কিছু অস্থায়ী মেলার সঙ্গে খাওয়ার দোকানও বসে। মাটির সানকিতে পান্তা-ইলিশ খাওয়া মূলত এই সব দোকানিদের আবিষ্কার, যা পরে খুব দ্রুত অন্যরাও গ্রহণ করে। প্রাচীন বাংলা বা বাংলা সনের সঙ্গে এই ইলিশ খাওয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই।’
পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন দোলা দেয় জনমনে। আগে থেকেই চলে প্রস্তুতি। দেশজুড়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেয় বিভিন্ন স্তরের ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ। সেখানে নানা মুখোশে স্থান পায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম। সেখানে ফুটে থাকে সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ।
এই মঙ্গল শোভাযাত্রার বর্তমান অর্জন সবার জানা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের ইউনেস্কোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।
অথচ, বহুবার আঘাতে জর্জরিত হয়েছে দিনটির ইতিহাস-ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখ ঘিরে বাংলার মানুষের মধ্যে বাড়ে হৃদ্যতা। একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময়ে জেগে থাকে দিনটি, চলে উপহার বিনিময়। এদিনে, নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পৃক্ত হয় কোটি জনতা, দিনটি ঘিরে হয় লালিত স্বপ্নের চর্চা। তাই—
‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক