পেঁয়াজ রপ্তানির ‘পাঁয়তারা’
২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। ওই সময় কৃষকের ঘরে পেঁয়াজ তোলার মৌসুম প্রায় শেষ। ভরা মৌসুমেও বাজারে পেঁয়াজের গভীর সংকট। মনে হয় এ নিত্যপণ্যটির গায়ে আগুন লেগেছে। দাম হঠাৎ করেই কেজিপ্রতি ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২২ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চারদিকে শুরু হলো হইচই।
পেঁয়াজের এ ঊর্ধ্বমুখী দাম কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি তৎকালীন বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতারা বাজারের ব্যাগ নিয়ে রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতে গিয়ে ক্রেতাদের নিয়ে প্রতিবাদ জানাতেন। আমরা বাজারে বাজারে গিয়ে এ সংবাদ সংগ্রহ করতাম।
ওইসময় প্রতিদিনের সংবাদপত্রে প্রধান শিরোনাম হচ্ছে পেঁয়াজ। বসে ছিলেন না সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব) থেকে শুরু করে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে কাজ করা সব সংস্থা ও সংগঠন মাঠে নেমে এলো। হইচই ও লঙ্কাকাণ্ড এ পেঁয়াজ নিয়ে। ওই সময় সংসদে চলছিল শীতকালীন অধিবেশন। প্রতিদিনই সংসদে এ নিয়ে আলোচনা হয়। অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান দেশবাসীকে পেঁয়াজ একটু কম খেতে আহ্বান জানিয়ে বড়ই বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর এ আহ্বান নিয়ে বেশ কয়েকটি পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছিল।
পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। শুধু তিনিই নন, অর্থমন্ত্রী এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীও আন্দোলনের তীব্রতায় ভীত হয়ে পড়েছিলেন মনো হলো। তীব্র আন্দোলনের একপর্যায়ে ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ মন্ত্রণালয় থেকে পদত্যাগ করে সরকারের ইজ্জত রক্ষা করলেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আনা হয় সাবেক বিমান বাহিনীর প্রধান (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে। দায়িত্ব বুঝে নিয়েই পরের দিন তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে একটি যৌথ সভার আয়োজন করেন। সভায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, কৃষক প্রতিনিধি, আমদানিকারক ও ভোক্তারা উপস্থিত ছিলেন। আলোচিত এ সভা কাভার করতে আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরাও উপস্থিত ছিলাম।
সভার শুরুতে আলতাফ হোসেন চৌধুরী একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে সবার মতামত জানতে চান। দীর্ঘ এ বৈঠকে উপস্থিত সবাই বক্তব্য দিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী সবার বক্তব্যর পয়েন্টগুলো নিজেই নোট করছিলেন। একপর্যায়ে একজন কৃষক প্রতিনিধি বলেন, “মাননীয় মন্ত্রী আমাদের যদি বীজ ও সার প্রণোদনাসহ আরো সহায়তা করা হয় তাহলে আমরা পেঁয়াজ উৎপাদন করে আমাদের নিজস্ব চাহিদা পূরণের পর বিদেশে রপ্তানির ‘পাঁয়তারা’ করতে পারব।”
কৃষক প্রতিনিধির মুখে ‘রপ্তানির পাঁয়তারা’ শব্দটি শোনার পরই একজন আরেক জনের মুখের দিকে তাকাতে থাকেন। কেউ কেউ হেসেও উঠেন। আলতাফ হোসেন চৌধুরী ওই কৃষক প্রতিনিধিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি একটু থামুন। কথা কম বলবেন। কাজ বেশি করবেন। বেশি কথা বললেই ভুল হয়। আপনি এই যে ‘পাঁয়তারা’ শব্দটি বললেন এখানে এটি ঠিক বলেননি। ‘পাঁয়তারা’ শব্দটি এখানে প্রযোজ্য নয়। এবার আপনি বলুন।
মতবিনিয় সভা শেষে ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজ’-এর সিনিয়র রিপোর্টার মোস্তাফিজ ভাই বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন রাখলেন- ‘মাননীয় মন্ত্রী আপনি সবার কথা শুনলেন। পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে আপনি কী পদক্ষেপ নেবেন।’ জবাবে আলতাফ হোসেন চৌধুরী বললেন, ‘আমরা কী পদক্ষেপ নেব, সেটা বলব না। আগামী পরশু দিন আপনারাই খুঁজে বের করে নিয়েন।’
ঠিকই ছিল বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা। পরের দিন থেকেই পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করে। এক সপ্তাহের মধ্যে দাম আগের অবস্থায়। সিন্ডিকেট শেষ। দোকানে দোকানে পেঁয়াজ আর পেঁয়াজ। বাজার স্বাভাবিক। পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক হওয়ার পর আবারও সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন আলতাফ হোসেন চৌধুরী। এক সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক হওয়ার কৌশল জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আপনাদের প্রকাশিত রিপোর্টগুলোকে আমি আমলে নিয়ে কাজ করেছি। আমরা ব্যবসায়ীদের স্বার্থের চেয়ে ভোক্তাদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেছি।’
২০০৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল। মাঝখানে কেটে গেছে ১৫ বছর। এ সময় পেঁয়াজের দাম নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে তেমন একটা হইচই হয়নি। ২০০৪ সালে নেওয়া পদক্ষেপগুলোই পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন ভোক্তারা। এ দীর্ঘ এ সময়ে পেঁয়াজের দরে খুব একটা হেরফের হয়নি। ২০০৭ সালে বহুল আলোচিত ১/১১-এর সরকারের আমলে চাল, ডাল, তেল, নুনসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যেরই দাম বেড়ে যায়। ওই সময় পেঁয়াজের দামও কিছুটা বেড়ে যায়। পরে অবশ্য তা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসে।
দীর্ঘদিন পর পেঁয়াজ নিয়ে দেশে রীতিমতো হইচই শুরু হয়েছে। ২৫ টাকা কেজি দরের নিত্যপণ্যটি এখন কোথাও কোথাও ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ নিয়ে সর্বত্র চলছে রসালো আলোচনা। কেউ কেউ বিয়েতে উপহার হিসেবে পেঁয়াজ দিচ্ছেন। প্রতিযোগিতায় পুরস্কারের তালিকায়ও স্থান করে নিয়েছে পেঁয়াজ। এগুলো আবার এখন খবরের শিরোনামও হচ্ছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর সকালে ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি মূল্য বাড়িয়ে দেয়। ওই দিন বিকেলেই পেঁয়াজের কেজি ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে একলাপে ৭০ থেকে ৯০ টাকা হয়ে যায়। পরের দিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি যৌথ সভার আয়োজন করে। সভায় একজন মাত্র ব্যবসায়ী প্রতিনিধি উপস্থিত হলেও তিনি কোনো কথা বলেননি। সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও উপস্থিত ছিলেন না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সদ্য যোগদানকারী সচিব ড. জাফর উদ্দিন সভায় সভাপতিত্ব করেন।
সভার একপর্যায়ে সিনিয়র সাংবাদিক শফিক ভাই সচিবকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মাননীয় সচিব আজকের এ বৈঠকে মন্ত্রী উপস্থিত নেই, এটাই বড় অভাব। আমার প্রশ্ন হলো- সকাল বেলায় ভারত রপ্তানি মূল্য বাড়িয়ে দিল আর বিকেল বেলায় আমাদের বাজারে এর প্রভাব পড়ে গেল। দাম দ্বিগুণ হয়ে গেল। এ ব্যর্থতা কার? আপনাদের বাজার তদারকির সুযোগে মজুদদাররা দাম বাড়িয়ে দিল। আপনাদের কী কিছুই করার নেই?
জবাবে বাণিজ্য সচিব বললেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাজার স্বাভাবিক হয়ে আগের জায়গায় চলে আসবে এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি। সেই ২৪ ঘণ্টার মেয়াদ তো আর আসেনি। বরং ৩০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ এখন ট্রিপল সেঞ্চুরির ঘর ছুঁইছুঁই করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদের বেশিরভাগ সদস্যই পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে বৈঠক করে নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। কার্গো উড়োজাহাজে করেও পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। এত কিছুর পরও পেঁয়াজ আগের ৩০ টাকায় পৌঁছাবে কি না, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
লেখক : সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, এনটিভি অনলাইন