দৃষ্টিপাত
বিচ্ছিন্ন মানুষ, দিকভ্রান্ত শিশু-কিশোর
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/01/12/photo-1484217020.jpg)
ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে মানুষ। বিচ্ছিন্ন কেবল আশপাশের মানুষের কাছ থেকে নয়, নিজের কাছ থেকেও। দুদণ্ড অবসর নেই। অবসরেও মুঠোফোন কিংবা ল্যাপটপ, কম্পিউটারে বুঁদ হয়ে থাকা—স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পাশের কারো দিকে কিংবা প্রকৃতিটাকে একটু ভালো করে দেখার ফুরসতটুকু মেলে না তাই। পাশের ছোট্ট শিশুর সামনে বাবা-মা যেমন ব্যস্ত ব্রাউজিংয়ে, তেমনি শিশুটিও থেমে থাকে না। অনবরত খেলে যায় মোবাইল কিংবা ট্যাব নিয়ে। যে বয়সটা খেলাধুলা, পড়াশোনা করা আর নানা কিছু শেখার, সে বয়সটা গণ্ডিবদ্ধ কেবল কয়েকটা কাজেই। এভাবে তাদের কতটুকু বিকাশ সম্ভব? নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়ার পথও যে রুদ্ধ! তাই যে শিশু বেড়ে উঠছে আজ, বড় হয়ে যদি বড় ডিগ্রিধারী অমানুষ হয়, সে দায় কার? নিশ্চয় আমাদেরই। তাই নয় কী?
উত্তরায় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান হত্যা আমাদের সে রকম বার্তাই দিচ্ছে। সমবয়সী কয়েকজনই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এর কারণ আর কিছুই নয়; আধিপত্য বিস্তার। শিশু-কিশোররা আজকাল পাড়া কিংবা মহল্লাজুড়ে গড়ে তুলছে অসংখ্য গ্যাং-গ্রুপ। তাদের মধ্যে আবার আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতাও চলে। এ জন্য হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করে না। এতটুকু বয়সে এ রকম অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠা এ সমাজের অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি ফুটে তোলে।
কেন এমন ঘটছে? চারপাশে তাকালেই মিলবে এর উত্তর :
শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দিচ্ছি না আমরা। আধুনিক শহর গড়ার নাম করে দিন দিন সংকুচিত করছি খেলার মাঠ। বইয়ের চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছি, কিন্তু পরিবার অথবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দিচ্ছি না নৈতিক শিক্ষা। ফলে মূল্যবোধ নামক কোনো বোধই তৈরি হচ্ছে না শিশুদের মননে।
নানাভাবে বিভেদ আর বৈষম্য শিশুদের করে তুলছে অসহিষ্ণু। তাদের মনোজগতে তৈরি হচ্ছে নেতিবাচক বিভিন্ন বিষয়।
ক্ষমতা কিংবা গায়ের জোরে এ সমাজে অনেক কিছু প্রতিষ্ঠা পায়। আধিপত্য যে দেখাতে পারে, তাকেই ক্ষমতাবান মনে করা হয়। ফলে শিশু-কিশোররাও নিজের ক্ষমতার দাপট দেখাতে চড়াও হচ্ছে অন্য শিশু-কিশোরদের ওপর। পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতাকেই তারা স্বাভাবিক ভাবছে। একই সঙ্গে প্রযুক্তি কিংবা আকাশসংস্কৃতিতে অবাধ বিচরণ সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আনছে অবক্ষয়।
ভর্তি-বাণিজ্য। ভুলে ভরা পাঠ্যবই। শিশু মনে ধর্মের বীজ প্রোথিত করা। প্রশ্ন ফাঁস। সার্টিফিকেট বিক্রি। পড়াশোনা শেষে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরাঘুরি করা। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস। তারপর ঘুষ-বাণিজ্য। ঘুষ না দিলে মেধাবী হয়েও হন্যে হয়ে ঘোরাঘুরি। এই যদি হয় অবস্থা, শিশু-কিশোররা শিখবে কী? ভবিষ্যতে জাতিকে উপহার দেবেই বা কী?
তাই শিশু-কিশোরকে দিকভ্রান্ত হতে না দিয়ে এখনই প্রয়োজন উদ্যোগী হওয়ার। পরিবার-প্রতিষ্ঠান-রাষ্ট্র সবারই প্রয়োজন শিশু-কিশোরদের প্রতি মনোযোগী ও যত্নবান হওয়া। সর্বোপরি সুশিক্ষা তথা নৈতিক শিক্ষায় বড় করে তোলা।
লেখক : বার্তাকক্ষ সম্পাদক, নাগরিক টেলিভিশন।