হকার উচ্ছেদ
পুনর্বাসন নিয়ে আগে ভাবুন
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/01/17/photo-1484650099.jpg)
রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ এলাকাতেই সড়ক ও ফুটপাত বলে এখন আর অবশিষ্ট কিছু নেই। মানুষকে হেঁটে চলতে হয় মূল সড়ককে পথ বানিয়ে। যানবাহনকে থেমে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সৃষ্টি হয় যানজট; বিপাকে পড়েন স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীরা; বাড়ে জনদুর্ভোগ আর বিড়ম্বনা। এই সমস্যা শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, সারা দেশের জেলা বা উপজেলা শহরগুলোতেও আজকাল ফুটপাথের দেখা মেলে না। দোকানিরা হরেক রকমের মালামালের পসরা সাজিয়ে আটকে রাখেন ফুটপাথ বা সড়কের অনেকাংশ। সড়কের সৌন্দর্য রক্ষা বা সাধারণের হেঁটে চলা পথ ছেড়ে দিলে তাদের নাকি পেট চলে না।
তাদের এই অবস্থাটা পুরোটা না হলেও অনেকটা মেনে নেওয়া যায়। কারণ এই রাষ্ট্র তাদের এমন পথ দেখায়নি যে, সুশৃঙ্খলভাবে নির্ধারিত জায়গায় বসে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন! কিন্তু কথা হলো, স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-পাতিনেতা, সড়ক বিভাগের আধিকারিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা; তাদের পেটের কী সমস্যা? তারা কেন দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে দিনের পর দিন ফুটপাথে হকারদের বসতে দেন আর কারা হকারদের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে অল্পদিনে কোটিপতি হয়ে ওঠেন? সবার আগে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করাটা জরুরি। তারপর হকার উচ্ছেদ করে পরিষ্কার নগরী গড়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া যাবে। আর তা যদি না হয়, গোড়ায় গাছ কেটে ওপরে জল ঢালার কোনো মানে নেই!
ফুটপাত দখলমুক্ত করতে এবং যানজট কমাতে গুলিস্তান ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় কয়েকদিন ধরে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ফুটপাতে রেখে যাওয়া হকারদের জিনিসপত্রও গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। হকাররা বাধা দিতে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে।
কোনোরকম পুনর্বাসন ছাড়া অব্যাহত উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে হকার্স ইউনিয়নের নেতারা পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটিকে তা অবহিত করেছেন। তাঁদের দাবিগুলো হলো- পুনর্বাসন ছাড়া হকারদের উচ্ছেদ করা যাবে না, হকারদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে, হকারদের ওপর দমন-পীড়ন, নির্যাতন বন্ধসহ প্রকৃত হকারদের তালিকাভুক্ত করে পরিচয়পত্র দিতে হবে।
এর সঙ্গে আমাদের দাবি হলো- সারা দেশেই সড়ক-মহাসড়ক থেকে দূরে হকারদের জন্য আলাদা বাজারের ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। ফুটপাথ রক্ষায় কঠোর আইন করতে হবে। পোশাককর্মী, শিক্ষার্থী বা সাইকেলচালকদের জন্য সড়কে আলাদা লেন করে দিতে হবে এবং সেসব লেনে হকার, ভিক্ষুক বা যেকোনো প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ জারি রাখতে হবে। আর হকারদের অবৈধভাবে বসিয়ে দিয়ে টাকা কামানো রাজনৈতিক নেতাকর্মী বা সরকারি কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করতে হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গত ১১ জানুয়ারি নগর ভবনে এক বৈঠক শেষে মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা দেন, রোববার থেকে সাপ্তাহিক কোনো কর্মদিবসে আর গুলিস্তান ও আশপাশের এলাকায় দিনের বেলায় ফুটপাতে হকার বসতে দেওয়া হবে না। হকাররা দোকান নিয়ে বসতে পারবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পরে। তবে ছুটির দিনে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।
এই কথার আলোকেই গেল দুদিন ধরে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তান ও এর আশপাশে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় ব্যবসা চালিয়ে আসা হকারদের পেটে আঘাত পড়ায় তারা এই উচ্ছেদ অভিযান মানছে না। চলমান অভিযানের ব্যাপারে মেয়র সাঈদ খোকন বলছেন, জনদুর্ভোগ লাঘব করতে এ এলাকায় দিনের বেলায় কাউকে বসতে দেওয়া হবে না। রাস্তা ও ফুটপাত দখলমুক্ত না করা পর্যন্ত এ অভিযান চলবে। সার্বিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। জনগণের পথচলা নির্বিঘ্ন করতেই আমাদের এ প্রচেষ্টা। এ ব্যাপারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অবস্থান পরিষ্কার, স্পষ্ট এবং কঠোর। তারা হলিডে মার্কেটে ব্যবসা করতে পারেন। হলিডে মার্কেট জমজমাট করার জন্য আমাদের উদ্যোগ রয়েছে। আমরা তাদের সহায়তা করব। আমরা চাই হলিডে মার্কেট সিস্টেমটা দাঁড়াক। আমরা মেয়রের সঙ্গে পূর্ণ সহমতেই থাকব।
কিন্তু দিনের বেলা দোকান করায় নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে দোকানিরা বলছেন, ‘আমরা তিনবেলা খাইতে বসছি। এখন আমাগোরে যদি বলে একবেলা খাইতে, তাহলে ক্যামনে হবে? এইভাবে তো ব্যবসা করা সম্ভব না।’ হকারদের এমন কথাও অমূলক নয়।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম গভীর দুঃসাহস নিয়ে বলতেন, ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপান ভীম রণভূমে রণিবে না, বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।’ কিন্তু আমাদের আধুনিক কালের নগরপিতা তাঁর উৎপীড়িত ভোটারদের ক্রন্দন রোলকে সারথি করে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাবেন কীভাবে? কিল দেওয়ার গোসাই হওয়ার আগে তো ভাত দেওয়ার মুরোদটা থাকা চাই।
যুগ যুগ ধরে অবৈধ দখলের যে ক্ষত ঢাকার সড়করা বয়ে বেড়াচ্ছে, তা সারাতে হলে সুষ্ঠু ও গঠনমূলক পরিকল্পনা থাকা চাই। একদিনে হুট করে এই রোগ দূর করা যাবে না। অন্যের অনিষ্ট করে নিজের আখের গোছানোর যে সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলেছি, আগে সেই কুসংস্কৃতি দূর করা চাই। যাঁরা ফুটপাত বা সড়ক দখলে রাখতে অন্ধকারে থেকে কলকাঠি নাড়েন, তাঁদের নিবৃত্ত করা হোক আগে। আগাছা জল না পেলে এমনিতেই দূরীভূত হওয়ার কথা। আমরা চাই ফুটপাত থাকুক পথচারী পারাপারের জন্য। সড়ক থাকুক যানবাহনের জন্য নির্বিঘ্ন। আর বাজার থাকুক নির্দিষ্ট জায়গায়। কাজেই উচ্ছেদ হোক, তবে হকারদের পুনর্বাসনটা সবার আগে।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন