পাঠ্যবইয়ে ভুল
শিশুদের কথা কেউ ভাবছেন কি?
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/01/19/photo-1484816432.jpg)
বিশেষজ্ঞ বা শিক্ষাবিদদের মতামত ছাড়াই বছর বছর বদলে ফেলা হয় দেশের পাঠ্যবই। হাজার বছরের বাঙালি আদর্শ বা সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে এসব বইয়ে বিশেষ গোষ্ঠী বা সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাধান্য দেওয়া কিংবা ভুলপাঠ উপস্থাপন করা হলে কিছুদিন মিডিয়া বা জনমনে তোলপাড় হয়; নতুন ইস্যুর ভিড়ে আবার তা হারিয়েও যায়। এভাবেই চলছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল স্তম্ভ পাঠ্যবই বিতরণের ছেলেভুলানো উৎসব।
গেল কয়েক বছরের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ২০১৭ সালের শিক্ষাবর্ষেই সবচেয়ে বেশি পরিবর্তিত ও ভুলে ভরা পাঠ্যবই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়ে প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে শিক্ষামন্ত্রী নিজে সংবাদ সম্মেলন করে জানান, পাঠ্যবইয়ের ভুলগুলো আঠা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সংশোধিত বই প্রকাশ করা হবে। সেইসঙ্গে পাঠ্যবই ভুলের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
কিন্তু এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে পাঠ্যবইয়ে ভুলের মূল হোতারা রয়ে গেছে দৃষ্টির আড়ালেই। এমন কি ধর্মীয় উগ্রবাদে বিশ্বাসী হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন পরামর্শ অনুসারে পাঠ্যবই অদলবদলের বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীল কেউই স্বীকার করছেন না। পাঠ্যবইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কুসুমকুমারী দাশ কিংবা হুমায়ূন আজাদের মতো খ্যাতিমান লেখকদের লেখা বদলে ফেলা বা বাদ দেওয়া হলেও এর কারণ কী, তার সদুত্তরও কেউ দিচ্ছেন না।
কিন্তু পাঠ্যবইয়ে ‘হিন্দুত্ব ও নাস্তিক্যবাদ’ ছেঁটে ফেলায় হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী কিংবা চরমোনাই পীরেরা সরকারের প্রশংসা করেছেন। তাঁরা বলছেন, পাঠ্যবই থেকে ‘নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দু তত্ত্বের বিষয়বস্তু’ বাদ দেওয়ার সরকারি উদ্যোগ প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক। কোনোরকম বিশেষজ্ঞ মতামত বা লেখক, সম্পাদকের সঙ্গে পরামর্শ না করে এভাবে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু বদলের তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের সচিবদের তদারকিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্তাব্যক্তিরা ভুলে ভরা বই ছাপিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে বইয়ের বিষয়বস্তুতে নজরদারির চেয়ে বই ছাপানোর সিন্ডিকেটের ব্যবসা-বাণিজ্যের ঘেরাটোপেই কর্তাব্যক্তিরা বেশি মনোনিবেশ করেছিলেন। আর এই বাজে বাণিজ্যের খেসারত দিতে গিয়ে সেসব ভুল ছাপা বই এখন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে। সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক আঠা দিয়ে ঢেকে না দেওয়া পর্যন্ত ইংরেজি শব্দ heart মানে আঘাত করাই শিখতে থাকবে শিশুরা। ‘ও’ অক্ষর শিখতে গিয়ে ওড়নার খবর আগে জানবে আর ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতার মারাত্মক বিকৃতিটাই মগজের কোষে সঞ্চিত করবে বালক-বালিকারা।
এই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সুশিক্ষার যুগেও কোনো বিশেষ উগ্রবাদী চক্র ‘নাস্তিক্য বা হিন্দুত্ববাদে’র ধোঁয়া তোলে মানুষকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের বিভাজিত বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট করতে চায়; দেশ ও মানুষকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যায়। এবং এই গোষ্ঠীকেই তোষণ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এখানকার কর্তাব্যক্তিরা কি ভাবেন, মানুষে মানুষে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার বৈশ্বিক এই যুগে উগ্র সাম্প্রদায়িক ভাবনা কেবল বিশ্ব থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করবার পথই দেখাবে; আর কিছু নয়!
সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠীকে খুশি করতে গিয়ে বইয়ের পাঠ বদলে ফেলার মূল কুশীলব হলো- ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটি বা এনসিসিসি। বইয়ের ভুল বা বিকৃতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে এনসিটিবির তরফে একটি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটিতে আবার রাখা হয়েছে সেই এনসিসিসির কর্মকর্তাদেরই। আর পাঠ্যবইয়ের ভুলের জন্য ওএসডির নামে নামকাওয়াস্তে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক প্রীতিশ কুমার সরকার এবং ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ লানা হুমায়রা খানকে এবং একই প্রতিষ্ঠানের আর্টিস্ট কাম ডিজাইনার সুজাউল আবেদীনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একেই বোধহয় বলে ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’। অথচ ভুল বা বিকৃত পাঠের যারা মূল কুশীলব তারা আছে আগের মতোই যে যার পদে।
বই বিকৃতির মতো এত বড় অঘটনের দুর্বার কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। সচেতনমহল মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন। ছাত্র ইউনিয়ন ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন সভা-সমাবেশ করে প্রতিবাদ করেছে বটে, কিন্তু তাতে শিক্ষামন্ত্রীর টনক নড়েছে বলে মনে হয়নি।
এবারের পাঠ্যবইয়ের অদলবদল, বিকৃতি বা ভুলের সব দায়িত্ব ছিল এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক সরকার আবদুল মান্নান এবং আরেক সদস্য (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মশিউজ্জামানের ওপর। আর সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা ওপর। অথচ শিক্ষামন্ত্রণালয় মধ্যম মানের দুজন কর্মকর্তা ও নিম্নমানের একজন কর্মীর বিরুদ্ধে সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণ করেই তাদের দায় শেষ করেছে। এমন করে বরাবর রাঘববোয়ালরা গিলে খায় চুনোপুঁটিদের। কিন্তু এভাবে সচেতন আমজনতার চোখে কি সত্যি ধুলা দেওয়া যায়?
এনসিটিবির কর্মকর্তারা সরকারের ওপর মহলের নির্দেশেই উগ্র মৌলবাদীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, যে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীবাহিনী অসাধু সিন্ডিকেট বাণিজ্যে জড়িত হয়ে পড়ে, সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়, সর্বোপরি কোমলমতি শিশুদের নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে উঠতে পারে; আর যাই হোক শিক্ষার্থীদের জন্য মননশীল বই উপহার দেওয়ার নৈতিকতা তাদের থাকতে পারে না।
সবার ওপরে সব ভুলভ্রান্তির দায় শিক্ষামন্ত্রীর নিজের। কিন্তু তিনি কি তাঁর দায় স্বীকার করবেন? অতিদ্রুত শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তর থেকে সব অযোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে দেওয়া হোক। বই বিকৃতির সঙ্গে জড়িতদের চাকরিচ্যুত কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানাই। পাঠ্যপুস্তক সৃজনে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের নিয়োগ দেওয়া হোক আর বিশ্বমানুষকে ভালোবেসে বহুমত শিক্ষার মাধ্যমে অবুঝ শিশু শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠবার সুযোগ যেন নিশ্চিত করা হয়। বিশ্বসমাজে এগিয়ে থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন