বিধানসভা নির্বাচন
ভারতের রাজনীতির গতিপথ বদলাবে?
ভারতের রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ৪০৩ আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৩২৫। উত্তরাখন্ড রাজ্যেও বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। অন্যদিকে পাঞ্জাবে জয় পেয়েছে কংগ্রেস। গোয়া ও মনিপুরে কংগ্রেস বেশি আসন পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তবে এসব রাজ্যেও বিজেপি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে যাচ্ছে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
ভারতের সবচেয়ে জনবহুল উত্তর প্রদেশ রাজ্যের নির্বাচন নরেন্দ্র মোদির জন্য বড় পরীক্ষা ছিল। কারণ, নভেম্বরে দেশে চালু নোটের ৮৬ শতাংশ বাতিল বলে ঘোষণা করে সরকার। ৫০০ আর এক হাজার টাকার নোট বাতিলের পর সারা দেশের মানুষ ব্যাপক সমস্যার মুখোমুখি হয়। নরেন্দ্র মোদির সরকারও ব্যাপক সমালোচনায় পড়ে। তার পরও উত্তর প্রদেশে অভাবনীয় জয় পেয়েছে নরেন্দ্র মোদির দল। বলা যায়, একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
উল্লেখ্য, কংগ্রেস ভারতের একটি প্রাচীন সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতির মাঠে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে বিজেপির জনপ্রিয়তার কাছে। এমনকি সাংগঠনিকভাবে কংগ্রেসের যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থান থাকার পরও বিধানসভার সাম্প্রতিক ফলে সবাই বিস্ময় প্রকাশ করছে। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে সাংগঠনিক কাজকর্মে তাদের মাঝে প্রাণের সঞ্চার হলেও নির্বাচনের ফলাফলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া সমাজবাদী পার্টিও উত্তর প্রদেশে সাংগঠনিকভাবে শক্ত অবস্থানে। এমনকি ১৯% মুসলিম ভোট তারা কখনও মায়াবতীর পক্ষে অবস্থান নেয়, কখনও সমাজবাদী পার্টির পক্ষে থাকে। তবে তারা কখনও বিজেপির পক্ষের ভোটার নয়। কিন্তু এবারের ফলাফলে বিষয়টি অন্য রকম মনে হচ্ছে। অনেক প্রার্থীই অভিযোগ করেছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের কারচুপিতে ভোটের ফল এমন হয়েছে। অন্যদিকে অনেকেরই আশঙ্কা ছিল যে, বিজেপির পক্ষে এবার হিন্দু ভোট একরোখা করে তোলা সম্ভব হবে না। তারপরও ভোটের চিত্র দেখে সমীকরণ মেলানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উত্তর প্রদেশের ভোটের ফল জাতীয় রাজনীতিতে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সংসদীয় রাজনীতিতেও বিজেপিকে সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে এসেছে। সংসদের উচ্চকক্ষে বিজেপি এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নয়। ফলে মোদি সরকারের আনা অনেক বিলই সেখানে আটকে যায়। কিন্তু রাজ্য বিধানসভায় নবনির্বাচিত বিজেপি সদস্যের ভোটে যতজন সংসদ সদস্য রাজ্যসভায় পাঠাতে সক্ষম হবে বিজেপি, তার ফলে উচ্চকক্ষের সেই সংখ্যার ভারসাম্য অনেকটাই বিজেপির অনুকূলে চলে যাবে। গোয়া ও মনিপুরে কংগ্রেস ও বিজেপির হাড্ডাহাড্ডি অবস্থান হওয়ায় পার্লামেন্ট ত্রিশঙ্কু হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বর্তমানে বিজেপির পক্ষেই দল ভারী হচ্ছে। উত্তর প্রদেশে রীতিমতো ঝড় তুলেই জিতল বিজেপি। আগেও বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে দেশের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যটিতে। কিন্তু এবারের যে রায় দিয়েছে উত্তর প্রদেশের জনতা, বিজেপির ইতিহাসে তা অভূতপূর্ব।
এবারের নির্বাচনে নোট বাতিলের ইস্যু সামনে রেখেই বিরোধীরা তাদের নিজেদের মতো প্রচার করেছিল। তবুও বিরোধীদের সেই সমালোচনাকে পাত্তাই দেয়নি সাধারণ মানুষ। নোট বাতিলের পর বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের কাছে এটাই ছিল প্রথম বড় পরীক্ষা। কিন্তু সেই পরীক্ষায় একেবারে লেটার মার্কস নিয়ে পাস করতে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি। আর মোদির ঝড়ে বেলাইন হতে চলেছেন সমাজবাদী পার্টির নেতা ও রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব ও কংগ্রেস সহসভাপতি রাহুল গান্ধী।
ভারতের জাতীয় পর্যায়ে মূলত তিনটি রাজনৈতিক দল রয়েছে। এগুলো হলো কংগ্রেস, বিজেপি ও কমিউনিস্ট পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টি কখনো নির্বাচনে জয়ী হয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠন করেনি। কংগ্রেস দল দীর্ঘ সময় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাসীন ছিল। বিজেপি দুই মেয়াদে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছে। রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে প্রায় সবকটিতেই একসময় কংগ্রেস দল ক্ষমতায় ছিল। তারপর তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা খর্ব করে বিভিন্ন রাজ্যে কয়েকটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করেছে। খর্ব করা হলেও রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্য ছিল। সাম্প্রতিক বিধানসভার নির্বাচনের ফল দেখে মনে হয়েছে, কংগ্রেস ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে তার গুরুত্ব ও প্রভাব দ্রুতগতিতে হারাচ্ছে। এর ফলে ভারতের জাতীয় রাজনীতির চেহারা সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা তা হলো, এই পরিবর্তনে পরিবারতন্ত্রের অবসান হতে পারে, অর্থাৎ কংগ্রেস দলের নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারকে আগের মতো শক্তিশালী ভূমিকায় দেখা যাবে না। এটা হলে ভারতের রাজনীতিতে বিশাল এক পালাবদল ঘটবে।
বিজেপি ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজের জনপ্রিয়তা যে বাড়িয়ে চলেছে,, তার প্রমাণ পাওয়া গেল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রাজ্যপর্যায়ের বিধানসভার নির্বাচনে। এর প্রভাব শুধু কংগ্রেসের জনপ্রিয়তার ওপর পড়বে না, বিজেপির রাজনৈতিক এবং মতাদর্শিক এজেন্ডার বাস্তবায়নেও দেখা যাবে। শুধু কেন্দ্রে সরকার গঠন করে এই দলের পক্ষে তার মতাদর্শিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে পারেনি। কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্যগুলোতেও বিজেপি সরকার গঠিত হলে তার পক্ষে এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হয়ে আসবে। ভারতের রাজনীতি সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে হয়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।