গ্রিক দেবী নিয়ে রাজনীতি
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রাঙ্গণে শাড়ি পরা গ্রিক ন্যায়বিচারের দেবী থেমিসকে নিয়ে লড়াইয়ের কারণ এটা দেশটির প্রচলিত সংস্কৃতি ও রাজনীতি উভয়ের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ভাস্কর্যটি স্থাপন করার পর থেকেই ইসলামপন্থীরা সেটি অপসারণের দাবি তুলেছে। দাবিটি রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতির প্রকৃতি নিয়ে প্রধান সংগ্রামে রূপ নিয়েছে।
গত ১১ এপ্রিল ইসলামপন্থী জোটের সদস্য হেফাজতে ইসলাম তাদের শিক্ষাব্যবস্থা কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একটি চুক্তিতে সই করে। এর ফলে ওই মাদ্রাসা থেকে পাস করা লোকজনের জন্য চাকরির নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতির চেয়ে সামাজিকভাবে অনেক প্রয়োজনীয় একটি ফলপ্রসূ ইসলামী মিত্র পেয়েছেন। ওই চুক্তি সই করার সময় হেফাজত মূর্তিটি অপসারণের দাবি নতুন করে জানায়। প্রধানমন্ত্রীও মূর্তিটির ব্যাপারে তাঁর অপছন্দের কথা প্রকাশ করেন এবং বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে কথা বলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
গত ২৬ মে রাতের অন্ধকারে হঠাৎ করে মূর্তিটি অপসারণ করা হয়। সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য ইসলামপন্থীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। তবে ‘উদারপন্থীরা’ এ জন্য ফেসবুকের পাতায় কান্না করেন। অবশ্য সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বিএনপি উভয়েই বিরলভাবে একমত হয়, শেখ হাসিনার সরকার নয়, সুপ্রিম কোর্টই মূর্তিটি অপসারণ করেছে।
দুদিন পর সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের প্রাঙ্গণে মূর্তিটি প্রতিস্থাপন করা হলে সেটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। ইসলামপন্থীরা নতুন করে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, তারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবি করে। এখন এটা কেবল মূর্তি নিয়ে লড়াই নয়, আরো বড় বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে। এখন মনে হচ্ছে, বিচার বিভাগ এবং অন্যদিকে নির্বাহী ও আইন পরিষদ বিভাগের মধ্যকার সংঘাত সর্বোচ্চ পর্যায়েও উপনীত হয়েছে।
তিন সংস্কৃতি ও দুটি সংশোধনীর লড়াই
শাড়ি পরা, তরবারি হাতে থাকা গ্রিক মূর্তিটি দেখতে উদ্ভট। সেই সঙ্গে এটা বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমের ইউরোপীয় উৎসকেও প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। উপনিবেশ আমলে চালু হওয়া অনেক আইন নানাভাবে এখনো বাংলাদেশে প্রচলিত। অন্যদিকে ইসলামপন্থীরা শরিয়াহ আইনের পক্ষে। ফলে এটা সাংস্কৃতিক সংঘাত।
প্রধানমন্ত্রী পড়ে গেছেন দুই পক্ষের মধ্যে। তিনি মূলত বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন। এই শ্রেণিটি আবার উভয় বিধানই অনুসরণ করে। কিন্তু ধনী শ্রেণির নোংরা জীবনযাত্রার কারণে উদারপন্থীরা পিছু হঠেছে। এর ফলে পল্লী ও রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণি শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সংঘাতের প্রভাব বিপুল, তবে তা কিছুটা আড়ালেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সম্ভবত বিচারপতি সিনহাই নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছেন, বিচার বিভাগের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার স্বঘোষিত মিশনে লড়াই করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন।
তিনি ষোড়শ সংশোধনী বিল বাতিল করেছেন। সংবিধানের ওই সংশোধনীতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল পার্লামেন্টকে। এখন বিচারপতি সিনহার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে তা নিয়ে আপিল আবেদনের শুনানি চলছে। যুক্তিতর্কের সময় প্রধান বিচারপতি এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হচ্ছে। তিনি দুই মন্ত্রীকে আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করেছেন, তিনি বেঞ্চ ত্যাগের পর অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারক তাঁর দেওয়া রায়গুলোর চূড়ান্ত করতে প্রকাশ্যে বলেছেন।
এই ইস্যুটির রাজনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে। কারণ পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়টিও আগের বিচারপতি লিখেছিলেন অবসর গ্রহণের পর। বর্তমান সরকার ওই সংশোধনীর ফসল। পঞ্চদশ সংশোধনীর যেকোনো ধরনের নেতিবাচক বিবেচনা কেবল বর্তমান সরকারের আয়ুতেই প্রভাব ফেলবে না, সেটা ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বিরূপ ধারণাও সৃষ্টি করবে।
ইসলামপন্থীদের সীমা
ইসলামপন্থীরা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হলে শেখ হাসিনা তাদের ওপর দমন চালাবেন। ২০১৩ সালে হেফাজতকে ব্যবহার করে শেখ হাসিনাকে উৎখাতের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু হাসিনা তাদের ঢাকা থেকে বিদায় করে দেন। যুদ্ধাপরাধী মামলায় নেতাদের ফাঁসি হওয়া জামায়াতে ইসলামী যদি আন্দোলনে যোগ দেয়, তবে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কিত জামায়াতের ওপর পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ চালাবেন শেখ হাসিনা।
অনেকের আশঙ্কাকে সত্য পরিণত করে ইসলামপন্থী জনতা যদি মূর্তিটির ওপর আক্রমণ চালায় কিংবা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, তবে সরকারি বাহিনী কঠোরভাবে পরিস্থিতি দমন করবে। শিক্ষা সনদপ্রাপ্তির সম্ভাবনা সৃষ্টির সময়টাতে হেফাজত মূর্তিটি পুনঃস্থাপন নিয়ে যতই ক্ষুব্ধ হোক না কেন সেটা হারাতে চাইবেন না তাঁরা। ফলে মনে হচ্ছে, একটি অচলাবস্থা বিরাজ করতেই থাকবে।
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক