খান আতা প্রসঙ্গে সোহেল রানার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া
অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমান প্রসঙ্গে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (সাবেক ইকবাল হল) তৎকালীন ভিপি, ছাত্রলীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধেয় মাসুদ পারভেজের একটি বিবৃতি আমার এক প্রিয় বন্ধু গতকাল সন্ধ্যায় আমাকে ইনবক্স করেন। আমি সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম। মাসুদ রানা অর্থাৎ সোহেল রানা সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, প্রস্তুতি অর্থাৎ ’৬৬ ’৬৯-এর ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করেছেন। বলেছেন,‘বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষ তো আর যুদ্ধ করতে যায়নি-তারা কি তাহলে রাজাকার?’ নিঃসন্দেহে নয়। একটা জাতির সকল সদস্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না। যুদ্ধ করবার মতো সাহস সকলের থাকেও না। বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাঁচাতে এবং উদ্ভূত বাস্তবতায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি বুঝে-শুনে যুদ্ধে যোগ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধার পরিমাণ ২০ শতাংশ বলে উল্লেখ করেছেন। আমি এই সংখ্যাটাকেও যথাযথ বলে মনে করি না। এই সংখ্যাটা আরো কম ছিল বলে আমার ধারণা।
বুঝে-শুনে যুদ্ধে যোগ দেওয়া কথাটির মানে কী দাঁড়ায়? ধারণা করি এই নগণ্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাগণ বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। এবং বিপ্লব সম্পর্কে তাদের দীক্ষাও ছিল সন্তোষজনক পর্যায়ের। বিপ্লবী চেতনার বাইরে উদ্ভূত বাস্তবতায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া যে ৮০ শতাংশ মানুষের কথা আপনি বলছেন, তারা কারা? তারা সমাজের নিম্নকোটির মানুষ,মজুর ও বর্গাচাষিই তাদের প্রধান পেশাগত পরিচয়। এরা যুদ্ধ শেষ করে অস্ত্র সারেন্ডার করে নিজ নিজ জায়গায় ফিরে গেছেন। শেখ হাসিনা সরকারের দেওয়া ১০ হাজার টাকার মাসিক সম্মানি বাদে এখন অব্দি তাদের আর কিছু নেই। অনেকের বসবাস করার মতো ভিটেমাটিও নেই। অর্থাৎ স্বাধীন দেশে তাদের বিশেষ কোনো ভাগ্যবদল ঘটেনি। জনাব সোহেল রানা তাঁর বিবৃতিতে জানাচ্ছেন, ‘স্বাধীনতার পরপর কয়েকজন শান্তিনগরে খান আতাকে ‘রাজাকার’ হিসেবে আটক করেছিল।’ এই ‘কয়েকজন’ ব্যক্তিই বা কারা? ওই মুহূর্তে দেশে কোনো ফাংশনাল পুলিশ বাহিনী ছিল না।তাহলে ধারণা করা যায়, ওই ‘কয়েকজন’ হলো গেরিলা বা মুক্তিযোদ্ধা। আপনি যেহেতু নায়ক, তাই নায়কোচিত কায়দায় মুহূর্তেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন আর আটককারী ব্যক্তিদের পিটিয়ে বলেছেন,‘খান আতা তোদের বাবা।’ ক্ষমা করবেন ভাই, এটাই আপনার বিপ্লবী চেতনা! একজন কোলাবরেটরকে বাঁচাতে আপনি সহযোদ্ধাদের পিটিয়েছেন এবং বলেছেন, ওই কোলাবরেটর তাদের বাবা। এটা কখনোই বিপ্লবী সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
শ্রদ্ধেয় সোহেল রানার নিকট বিনীত জিজ্ঞাসা, মুক্তিযুদ্ধকালে এরশাদ সাহেবের ভূমিকা কী ছিল? তিনি পাকিস্তান আর্মির সদস্য হিসেবে পারফর্ম করেছেন নাকি যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন? আপনি আপনার সমুদয় বিপ্লবী চেতনা আর দীক্ষা নিয়ে কীভাবে তাঁর দলে নাম লেখালেন?
খান আতার শিল্পী সত্তাকে আমরা অস্বীকার করছি না।খান আতা যদি শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান বা আলতাফ মাহমুদের মতো ঐতিহাসিক ভূমিকা নিতে পারতেন তাহলে-তো এতসব কথার প্রয়োজন পড়ত না। যদি প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতেন তা-ও চলত। কিন্তু কোনোটাই না, তিনি পুরোটা সময় রেডিও-টেলিভিশন করেছেন। আর রেডিও-টেলিভিশনে তখন কী ধরনের আনুষ্ঠানাদি হতো তা-বোধহয় তদন্তের দরকার নেই। পরিবার পরিজন উল্লিখিত মহান ব্যক্তিবর্গেরও ছিল।
আপনি বলেছেন, খান আতা পাকিস্তানের পক্ষে কোনো গান লেখেননি। আতাউর রহমান যদিও সেটা স্বীকার করছেন না। তাহলে কি ঢাকার রেডিও টেলিভিশন থেকে ওই নয় মাসব্যাপী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল? আমরা আপনাকে অবিশ্বাস করতে চাই না। তবে যে বিপ্লবের দোহাই আপনি দিচ্ছেন এবং নিজেকে গণযোদ্ধাদের চেয়ে শ্রেয়তর দাবি করছেন সেটা একবার পুনর্মূল্যায়ন করুন। আপনার ভাষ্য মোতাবেক খান আতা যদি মুক্তিযুদ্ধের একজন সমর্থকও হতেন তাহলে যুদ্ধের পরপর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে গ্রেপ্তার করত না। আমরা খান আতার বিচার দাবি করছি না। তিনি বিচার্য যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো নিষ্ঠুরতায় লিপ্ত হয়েছেন, সেটাও বলছি না। তবে আপনি যদি বিপ্লবী হতেন তাহলে একজন কোলাবরেটরকে বাঁচাতে সহযোদ্ধাদের গালিগালাজ কিংবা গায়ে হাত তোলা থেকে দূরে থাকা আপনি তার শাস্তি কার্যকর করতেন।
লেখক : বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা।