দৃষ্টিপাত
নারীর প্রতি সহিংসতা সভ্যতার বড় অভিশাপ
বিশ্বসমাজে পুরুষতন্ত্র এখনো এমন এক ব্যামো, যেখান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রগতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুরুষ প্রতিক্রিয়াশীলরা দাবড়ে বেড়াচ্ছে চারপাশ। বিশ্বব্যাপীই নারীকে দ্বিতীয় লিঙ্গ বিবেচনা করে পুরুষরা। ‘মি টু’র হ্যাশট্যাগে প্রতিবাদ চলে বটে, কিন্তু অন্ধকার দূরীভূত হয় না। তবে বাংলাদেশে এই ধারাটা খানিকটা বেশিই। এখানে নারীকে পণ্য করা যায়, নারীর অস্তিত্বকে বিলীন করে দেওয়া যায়। মন চাইলে নারীকে কেটে টুকরো করে নিশ্চিহ্ন করবার পাঁয়তারাও করা যায়।
নিপীড়িত নারীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ তনু, মিতু বা রূপাদের চাঞ্চল্য শেষ। প্রতিবাদের আগুন আমাদের মননে বেশিদিন জ্বলে না। আমরা খুব শিগগির সবকিছু ভুলে যেতে পারি। এবার কাপুরুষদের হিংস্রতার শিকার বরগুনার কলেজছাত্রী মালা আক্তার।
এনিটিভি অনলাইনের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, স্ত্রীর কিশোরী মামাতো বোনের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে ওই বোনকে গলা কেটে হত্যা করেছেন বরগুনার ঘটবাড়িয়া আদর্শ কলেজের প্রভাষক আলমগীর হোসেন পলাশ। এরপর লাশ গুম করতে মৃতদেহ সাত টুকরো করার পর ধুয়ে সাফসুতরো করে দুটি ড্রামে ভরে ফেলেন। এমন অপকর্মে ওই শিক্ষককে সহায়তা করেন তারই আত্মীয় মাইনুল আহসান বিপ্লব নামের এক অ্যাডভোকেট, যিনি কি না বাংলাদেশের দণ্ডবিধি ভালো জানেন। অপরাধ তদন্ত নিয়েও কাজ করেন।
তবে শেষ রক্ষা হয়নি। শিক্ষক তাঁর নিষ্ঠুরতার পাপ ধামাচাপা দিতে পারেননি। পুলিশের কাছে ধরা পড়েছেন। আদালতে দোষও স্বীকার করেছেন ওই শিক্ষক নামের কলঙ্ক।
পুরুষের চাপিয়ে দেওয়া অভিশাপ আজন্মই বয়ে বেড়াতে হয়েছে মালার। গর্ভে থাকা অবস্থায় তার বাবা মো. আবদুল মান্নান মালার মাকে তালাক দেন। জন্মের পর প্রায় ১৩ বছর পর্যন্ত আপন মামার কাছে লালিতপালিত হয় মালা। মালার মা আকলিমা বেগমকে ঢাকায় এক শ্রমিকের সঙ্গে আবার বিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় খুব স্বাভাবিকভাবেই মায়ের নতুন সংসারে মালার নিরাপত্তা মেলে না। বাবাহারা ও মায়ের মমতাবঞ্চিত মালা কখনো এ-স্বজন, কখনো ও-স্বজনের বাসায় থেকে এসএসসি পাস করে। পরে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কলাপাড়া মেনহাজ উদ্দীন বিশ্বাস কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় সে। শেষ পর্যন্ত দুলাভাইয়ের প্রেমের ফাঁদে পড়ে অকালে প্রাণ হারায় ১৭ বছর বয়সী সংগ্রামী মালা।
কোথায় দাঁড়াবে নারী? পিতা তাকে পর করে, মা অথবা মায়ের ভাইদের কাছেও নিরাপত্তা পায় না। শেষ পর্যন্ত বোনজামাইদের স্বার্থরক্ষা করতে না পারায় নিভিয়ে দিতে হয় জীবন-প্রদীপ।
এভাবে কতশত মালা পুরুষের নির্মমতায় নিঃশেষ হচ্ছে, আমরা তার খবর জানি না। সব খবর মিডিয়ায় আসে এমনও না। আর আমাদের আধুনিক জীবনে সব ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়ও তোলে না। এই যেমন কিশোরী মালার প্রতি সহিংসতা নিয়ে কোথাও কোনো ‘টুঁ’ শব্দটি পর্যন্ত নেই। একদিন হয়তো আইনের ফাঁক গলিয়ে আবার খুনি প্রভাষক/উকিলরা এই মনুষ্য সমাজে বুক ফুলিয়ে হাঁটবে আর গর্বের সঙ্গে আরেক নারীর জীবন বরবাদ করবে।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ৮০ শতাংশ নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে স্বামী নামের পুরুষের কাছে। আগে কেবল শারীরিক নির্যাতনকেই সহিংসতা বলে মনে করা হতো। ২০১০ সালে প্রণীত পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন অনুযায়ী এখন মানসিক নির্যাতনকেও নারীর প্রতি সহিংসতা বলে বিবেচনা করা হয়। এটাকে অনেকে হয়তো নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে অধিকতর সংবেদনশীলতা হিসেবে দেখতে চান। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দিন যাচ্ছে আর বিচিত্ররূপে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েই চলছে। ন্যক্কারজনক এসব সহিংসতার সঙ্গে আইন প্রয়োগের গতি খুব বেশিই পিছিয়ে থাকছে!
নারীকে পর্যুদস্ত করা এবং অবরুদ্ধ করে রাখবার যে পুরুষালি চিন্তা, তা দূর করতে আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পেরেছি কি? নীতিবাগিশরা বিভিন্ন ফোরামে পুরুষ ও নারীর সমঅধিকারের বিষয়ে নানা আলোচনা উপস্থাপন করেন। অথচ এই দেশে এখনো উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি অর্জনে পুরুষের সমকক্ষ নন নারীরা। সরকার এতদবিষয়ে আইন করতে গিয়েও প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীদের চাপে সেখান থেকে ফেরত এসেছে। অথচ এই প্রতিক্রিয়াশীলরাই বলে বেড়ান, তাঁদের ধর্মাচার নারীকে মুক্তি দিয়েছে। তাহলে মালা বা রূপার মতো নারীরা কোন মুক্তির নমুনা।
জেন্ডারবৈষম্য দূর করতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কিংবা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তার ছিটেফোঁটাও কি আমাদের মধ্যে আছে? এমন সংস্কৃতি কি আমাদের আছে, যেখান থেকে আমরা শিখব সমাজ ও সভ্যতা বিনির্মাণে নারী ও পুরুষ সমান দায়িত্বশীল? আমাদের শিশুদের কি এমন বিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হয়, যেখান থেকে তারা জানবে, শুধু নিজের জেন্ডারের প্রতি পক্ষপাত মনুষ্যত্ব নয়? আমাদের আইন, প্রথা, সংস্কৃতি, মেধা, মনন, চিন্তা বা চেতনা কোনোটাই কি নারী ও পুরুষের সমঅধিকারের পক্ষে? সর্বোপরি নারী ভিকটিমের প্রতি রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারও এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়।
প্রতিটি কর্মস্থলে নারীকে নানামুখী কাপুরুষোচিত রক্তচক্ষুর সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। অথচ এমন নয় যে, নারী পুরুষের চেয়ে কাজ কম বোঝেন! বরং অনেকে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি সৎ, কর্মনিষ্ঠ ও ত্যাগী। আধুনিক পুরুষও গান করেন, ‘মায়ের চেয়ে আপন কেহ নাই’! খানিক পরেই মায়ের কথা ভুলে গিয়ে নিজের পুরুষজন্মের গর্বে আত্মম্ভরিতায় ফিরে যান তিনি। সময় এসেছে নারীকে স্পেস দেওয়ার। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে আরো বেশি নারী লিডারশিপ সৃষ্টি করতে হবে এবং তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তবে যদি ঈর্ষা ভুলে নারীর প্রতি পুরুষের শ্রদ্ধাবোধ খানিকটা হলেও সৃষ্টি হয়।
মানবিক শিক্ষা ছাড়া পুরুষের মধ্যযুগীয় চরিত্র বদলানো অসম্ভব। সব ধর্মের পুরুষই নিজেদের মৌলবাদের দোহাই দিয়ে নারীকে অধস্তন করবার প্রয়াস পায়। তারা হাস্যকর ও অযৌক্তিকভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা, খুন বা ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক, চালচলন ও আচার-আচরণকেই দায়ী করে। নারী পুরুষের হাতে নৃশংসভাবে খুন হলেও সেই অপবাদের কলঙ্ক থেকে রেহাই পায় না। অথচ একজন পুরুষের তুলনায় নারীর সংগ্রাম আকাশস্পর্শী। নারীকে সন্তান লালনপালন করতে হয়, ঘর সামলাতে হয় এবং কর্মস্থলের কাজটুকুও ঠিকঠাক সামাল দিতে হয়। কিন্তু তার কপালে মর্যাদা জোটে খুব সামান্যই।
যত দিন না পুরুষের এমন হীন ধ্যানধারণা পালটানো যাচ্ছে, তত দিন পলাশের মতো পুরুষ শিক্ষক বা বিপ্লবের মতো উকিলদের আস্ফালন থামানো যাবে না। আইন দেখিয়ে যেহেতু পুরুষের আপন ভুবনে ঔদার্য ফেরানো গেল না, এখন প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের।
আমরা চাই, মালা আক্তারদের সংগ্রামী স্বপ্ন বিজয়ী হোক। পুরুষের পাপে অকালপতন না হোক কোনো নারী নক্ষত্রের। আমাদের কন্যাসন্তান, মা ও নারীরা মুক্তসমাজে সমান মর্যাদা ও অধিকারে নিরাপদ ও চিন্তামুক্তভাবে বেঁচে থাকবার ফুরসত পাক। নারীর প্রতি ক্রমাগত সহিংসতায় অভিশাপ না নামুক মানবীয় সভ্যতায়।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।
২৬ অক্টোবর-২০১৭