প্রতিক্রিয়া
নাঈমা তাসকিনের নতুন জীবন ও ভক্তের ভালোবাসা
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সম্ভাবনাময় পেসার তাসকিন আহমেদ বিয়ে করেছেন। তিনি গাঁটছড়া বাঁধলেন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু সৈয়দা রাবেয়া নাঈমার সঙ্গে। আমরা বিশ্বাস করি, কন্টকাকীর্ণ পৃথিবীর পথকে ভালোবাসা ও বিশ্বাসের স্বর্গে রূপ দিয়ে হাতধরাধরি করে যুথবদ্ধতায় হাঁটবেন তাঁরা। নবদম্পতির ভবিষ্যৎ মঙ্গলকামনায় আমাদের প্রাণান্ত উষ্ণ অভিবাদন।
বাংলাদেশ তথা বিশ্ব ক্রিকেটেই পরিচিত মুখ তাসকিন আহমেদ। এরমধ্যে ভারতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বোলিং অ্যাকশন অবৈধ প্রমাণ হওয়ার পর আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় পড়লে প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তাসকিন নিজেকে শোধরাতে পেরেছেন। এবং তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী দল ও দেশকে ক্রিকেটসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। খেলার ধরন অনুযায়ী কখনো ভালো করছেন। কখনও বা সময়টা খুব বাজে যাচ্ছে। সম্প্রতি শেষ হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে স্মরণকালের সবচে বাজে সময় পার করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। তাসকিনও এই বিপর্যয়ের অংশ। তবু দুঃখকে পুষে রাখলে জীবনের চাকা চলবে না। গেল মঙ্গলবার সকালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরেই রাতে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তাসকিন আহমেদ। বিয়ের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সফল অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। অনুমান করা যায় পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ের সময়টা পূর্বনির্ধারতই ছিল। বিয়ের আনিষ্ঠানিকতা শেষে তাসকিনের বাবা আবদুর রশিদ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘মেয়ে আগে থেকেই পছন্দ করা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বিয়ের আয়োজন করতে হলো। পরে সুবিধাজনক সময়ে বড় করে অনুষ্ঠান করব।’
বিয়ের পরের দিন তাসকিনের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে বিয়ের ছবি ছাপিয়ে পেজটির এডমিন নবদম্পতিকে শুভকামনা জানিয়েছেন। সবকিছু দেখে খুব স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে বিয়ে নিয়ে তাসকিন, তাঁর পরিবার ও স্বজনরা যথেষ্টই খুশি। আর বিয়েটা সবার জীবনেই এক অনির্বচনীয় আনন্দের অন্যতম উপলক্ষ।
তাসকিন তারকা খেলোয়াড় বলেই তাঁর ভক্তশ্রেণির অভাব থাকবার কথা নয়। তাসকিনের হঠাৎ বিয়েটা দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক স্বপ্নবাজ তরুণীর মন ভেঙ্গে দিয়েছে এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, অনেক নারী ফ্যানই রাতভর কেঁদেকেটে আকুল হয়েছেন। একজন মানুষ যেহেতু সবাইকে খুশি করবার সক্ষমতা রাখেন না, সেহেতু ভক্তের মন ভাঙ্গার এমন হৃদয়বিদারণ আমরা মানতেই পারি। কিন্তু তাসকিনের বিয়ের পর তাঁর পুরুষ ভক্তরা সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে যে হারে ট্রলের বন্যা ভাসাচ্ছেন তা সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনার মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়াটা পুরোদস্তুর অসম্ভব। যে যার খুশি মতো তাসকিনের বউকে নিয়ে উপহাস করছেন। বউয়ের শারীরিক গঠন ও অভিব্যক্তি নিয়ে অবমাননাকর ভাষায় নিন্দা করছেন। তাসকিন তাঁর ফেসবুকে যে পোস্টটিতে তাঁর বিয়ের কথা জানান দিয়েছেন, সেখানকার মন্তব্যের ঘরে চোখ রাখলে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়।
ভক্তের মন্তব্যে প্রমাণ পাওয়া যায় আমরা কতটা অভব্য জাতিতে পরিণত হয়ে গেছি। আমরা ভুলে যাই সোশ্যাল মিডিয়াটা একটা ভার্চুয়াল আয়না। যেখানে রোজকার ঘটনায় অযাচিত নাক গলিয়ে নিজেদেরকে প্রতিবিম্বিত করে যাই। সেখানে ভালোকথা বা ভালোবাসার যেমন একটা প্রভাব পড়ে তেমনি নিজের জাতপরিচয়টাও আমাদের উদ্ভট কথাবার্তা দিয়ে জানান দেই। কিন্তু কী এক সময়ে এসে আমরা উপস্থিত হয়েছি যে, সবাই নিজেদের রুচিবোধের বিকার দিয়ে নিম্নস্তরে পৌঁছে যেতেই আনন্দ পাচ্ছি। যে নাঈমাকে নিয়ে আপনাদের কুৎসিত ট্রল তাঁকে নিজের বোন বা কন্যা জায়গায় বসিয়ে আপনাদের দয়া বা করুণা কামনা করব না, একবার মানুষ হিসেবে ভেবে দেখুন তো, মানুষের নিন্দায় আপনার মনুষত্ব সভ্যতার নিক্তিতে টেকে কি না?
আমাদের বর্বরতা ও হীনমন্যতা কতটা সীমালঙ্ঘন করলে ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে ফেলতে পারি, ‘তাসকিনের বিয়ে মানি না!’ সেই ইভেন্টে আবার ১০ হাজারেরও অধিক মানুষ তাদের ইন্টারেস্টের কথা জানিয়ে হাস্যকরভাবে তাসকিনের বিয়ে ভাবনাটাকে বাতিল করবার দাবি জানাচ্ছে। এটা কি ছেলেখেলা? কী নির্লজ্জ আমরা, তাসকিনের খেলার হাজার প্রশংসা করতে করতে যেন বা আমরা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন প্রাচীনকালে দাস কেনাবেঁচার মতো করে কিনে নিয়েছি। জন্ম, মৃত্যু বা বিয়ের মতো প্রকৃতি নির্ধারিত বিষয়গুলোতেও এখন ভক্তরা ছড়ি ঘুরাবে? দিন দিন আমরা কি তবে ঈশ্বরের ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’ হয়ে উঠছি?
তাসকিনের বিয়ে পরবর্তী ভক্তের বাজে উন্মাদনার ব্যাপারে সবচে যুৎসই উত্তরটি দিয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার আশরাফুল ইসলাম। তিনি তাঁর ফেসবুক পেজে যথার্থ বলেছেন, ‘সাকিব, তামিম, মুশফিক, আমি, বা তাসকিন বিয়ে করার পর প্রতিবারেই আমাদের শুনতে হয় অমুক ক্রিকেটারের বউ বুড়া, তমুক ক্রিকেটারের বউ মোটা, অমুক ক্রিকেটারের বউ নাক বোঁচা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাসকিন ও রেহাই পেল না। তাসকিন কেন অল্প বয়সেই বিয়ে করল, তার বউ কেন সুন্দরী না, দাঁত বের করে কেন হাসে এসব কমেন্ট আর স্ট্যাটাসে ফেসবুক ভরে গেছে। সাথে তাসকিনকে নিয়ে ১৮+ বাজে ট্রলও দেখেছি অনেক।
আচ্ছা সংসারটা তাসকিন তার পছন্দ করা বউয়ের সাথে করবেন। সেখানে তার বউ সুন্দরী না দাঁত বের করে হাসে এটা বলার আপনি কে? সংসার তাসকিন করবে, আপনি নন। তাসকিন যদি তার বউয়ের সঙ্গে সুখী থাকে তাহলে সেখানে নাক গলানোর আপনি কে? এই অধিকার কোথায় পেয়েছেন? মানছি আমরা পাবলিক ফিগার, কিন্তু তাই বলে আমরা আপনাদের আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করার অধিকার দিয়ে দেইনি।
আমাদের পেশা ক্রিকেট খেলা। দর্শক হিসেবে আমাদের খেলা নিয়ে আপনি গঠনমূলক সমালোচনা করতেই পারেন, কিন্তু আমি কী খাব, কোন ড্রেস পরব, কাকে বিয়ে করব- এসব নিশ্চয়ই আপনি ঠিক করে দিতে পারেন না। কার বউ মোটা, কার বউ বুড়ি, কার বউয়ের দাঁত উঁচু এসব নিচু মানের কমেন্ট আর স্ট্যাটাস দেওয়ার আগে নিজেকে আয়নায় দেখেছেন তো?”
আমরা কি দেখতে পাই আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মগজের আয়নাটায় কেমন কালি পড়ে গেছে? সেখানে আর আলো পড়ে না, তাই আমরা শুধু অন্ধকার হাতড়ে ফিরছি। নাঈমা আমাদের ভালোবাসার ক্রিকেটার তাসকিনের প্রিয়তম স্ত্রী। আমরা জানান দিচ্ছি, তাসকিনকে আমরা খুব ভালোবাসি। তাহলে তাঁর জীবনঙ্গিনীর প্রতি আমাদের এত অশ্রদ্ধা কীসের? মানুষের সৌন্দর্য নির্ধারিত হয় তাঁর কর্ম, ব্যক্তিত্ব ও জীবনদর্শনে। গায়ের রং আর অভিব্যক্তি দিয়ে মানুষের তুল্যমূল্য নির্ধারণ খুবই প্রাচীন ভাবনা। মনের মধ্যে পুষে রাখা সেই পুরাতনপন্থার নোংরামিটা ঢেকে না রাখতে না পারাটা অধঃপতন, চরম নির্বুদ্ধিতা ও সীমালঙ্ঘন। যদি নিজেদের মানুষ দাবি করি, তবে আসুন মনের বিষাক্ত কলুষটাকে দূরীভূত করে হারিয়ে ফেলা সত্য ও সৌন্দর্যকে খুঁজে ফিরি আর তাসকিন আহমেদের নতুন জীবনকে স্বাগত জানিয়ে ভালোবাসার দায় মেটাই। ভক্তের হৃদয়স্পর্শী ভালোবাসায় তাসকিন ও নাঈমার নতুন জীবন সুশোভিত হোক। যে অজানা সাধনায় ঐশ্বরিক সুরের বাঁধনে নাঈমার প্রাণে বাঁধা পড়েছে তাসকিনের প্রাণ, রাবীন্দ্রিক কবির ছন্দ ও বকুল গন্ধ সেই সাধনায় জন্ম-জন্মান্তরে মিশে থাক।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন