আন্তর্জাতিক
পাকিস্তানের আইনমন্ত্রীর পদত্যাগের নেপথ্যে

পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। আর এই সাংঘর্ষিক অবস্থার সঙ্গে সরকারের পতন, রাজনীতিবদিদের ব্যর্থতা, নেতৃত্বের সংকট, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ—সবকিছুই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গত তিন সপ্তাহের কট্টর ইসলামপন্থীদের টানা বিক্ষোভ, সংঘর্ষের পর পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী জাহিদ হামিদ পদত্যাগ করেছেন। মন্ত্রীর পদত্যাগের ফলে রাজপথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে বিক্ষোভকারীরা। আটক হওয়া বিক্ষোভকারীদের মুক্তি, ক্লিনআপ অপারেশন বন্ধ করতে রাজি হওয়ার পর আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেয় তারা। আইনমন্ত্রী হামিদের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে বিক্ষোভ শুরু করেছিল কট্টর ইসলামপন্থীরা।
নির্বাচনী শপথের একটি অংশে মুহাম্মদ (সা.)-এর উল্লেখ বাদ পড়ার পর আইনমন্ত্রী জাহিদ হামিদের অপসারণ চেয়ে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। যদিও এ ঘটনা একজন কর্মচারীর ভুলে হয়েছে জানিয়ে ক্ষমা প্রার্থনাও করেছিলেন হামিদ। কিন্তু তাঁর সেই ক্ষমা প্রার্থনাকে যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে তাঁর পদত্যাগ দাবি করা হয়। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ‘আমি সরাসরি ওই বিতর্কিত সংশোধনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। তবে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে আমি আমার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ ভুল স্বীকার করা সত্ত্বেও মন্ত্রীকে রেহাই দিল না কট্টরপন্থীরা। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে কেন অহরহ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, এটিই আজকের প্রশ্ন।
পাকিস্তানের ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যেকোনো ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে—এমন আশঙ্কা শুধু সরকারের নয়, জনগণেরও। রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনীকে যেমন ব্যবহার করে থাকে, তেমনি সেনাবাহিনীও সরকারকে যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি করে তোলে। পাকিস্তানকে বলা যেতে পারে সেনাশাসনের আঁতুরঘর। এবারও আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন থামাতে সেনাবাহিনীকে তলব করা হয়। আবার এই সেনাবাহিনীই কোনো কোনো সময় রাজনীতিতে বাধা কিংবা শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে কোনো ধরনের স্বস্তির বাতাস নেই, তা সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক চিত্র দেখে অনুমান করা যায়। দেশটির সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ কিছুদিন আগে বলেছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভয়ংকর ‘ভাইরাস’ ঢুকেছে। তাঁর বক্তব্য, পাকিস্তানে নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর মেয়াদ পূরণ করতে দিচ্ছে না এই ভাইরাস। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীর পদত্যাগ সেখানকার রাজনীতিতে একটি বড় ব্যাধি।
বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় পাকিস্তানে অনবরত রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। আর এই সংকটাবস্থা চলছে গত ৭০ বছর ধরে। একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী গড়ে দেড় বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। অন্যদিকে সামরিক স্বৈরশাসকরা গড়ে নয় বছর করে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। উল্লেখ্য, দুর্নীতির অভিযোগে গত ২৮ জুলাই নওয়াজকে অযোগ্য ঘোষণা করেন দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। এরপরই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। এর আগেও নওয়াজ শরিফ দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। প্রথমবার দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন আর দ্বিতীয়বার সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়।
আরো একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। তা হলো, অক্টোবর মাসের ২ তারিখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহসান ইকবাল আদালতে ঢুকতে আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আদালতে ঢুকতে দেবেন না তাঁরা। অথচ এই মন্ত্রীর অধীনেই রয়েছে দেশের সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ঘটনাতেই বোঝা যায়, কেমন চলছে পাকিস্তানের সরকারব্যবস্থা। যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাধা দেন তাঁরই অধীনে থাকা বাহিনীর সদস্যরা, সেখানে আদতে সরকারব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হতেই পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি অভিযোগ করে বলেছেন, পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। গত ৪ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। দীর্ঘ মেয়াদে ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পরিস্থিতি ঠিক থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।’ কাজেই সম্প্রতি আইনমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনাটি যেমন ধর্ম অবমাননার মতো কোনো বিশেষ ইস্যুকে কেন্দ্র করে হলেও ক্রমাগতভাবে ঘটে যাওয়া পাকিস্তানের অস্থিতিশীল অবস্থার নেপথ্যে কে বা কারা দায়ী, তা খুঁজে বের করার সময় এসেছে।
আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট যখন অত্যন্ত আলোচিত-সমালোচিত, তখন ধর্ম অবমাননার দায়ে মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার বিষয়টি বিশেষ ষড়যন্ত্রের অংশও হতে পারে। পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবে দূরদর্শী নেতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে মোকাবিলা করতে না পারলে আরো ভয়াবহ সংকটময় আশঙ্কা তৈরি হওয়া অসম্ভব কিছু না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।