২০১৭
কেমন গেল বিশ্ব রাজনীতি?

একবিংশ শতাব্দীর আরো একটি বছর শেষ হয়ে গেল। উত্তাল বিশ্ব রাজনীতি, রোহিঙ্গা সংকট ও বাংলাদেশের মানবতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ, সৌদি সাম্রাজ্যে তরুণ রাজকুমার সালমানের প্রভাব প্রতিষ্ঠা, জিম্বাবুয়ের স্বৈরশাসক রবার্ট মুগাবের শাসনাবসান, ইসলামিক স্টেটের পতন ও সহিংস মধ্যপ্রাচ্য, কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে আন্দোলন ও গণভোট, তরুণ কিমের নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়ার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অভিলাষসহ নানা ঘটনায় মুখরিত ছিল ২০১৭ সাল।
রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ ছিল ২০১৭ সালের অন্যতম আলোচিত বিষয়। এই বছরেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ ইতিবাচক সুনাম ও ভাবমূর্তি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কখনো ছিল বাংলাদেশের সরব উপস্থিতি আবার কখনো বাংলাদেশ ছিল নেতৃত্বের আসনে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে পুরোনো বিরোধ মিটিয়ে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার সরকারের অন্যতম বড় কূটনৈতিক সাফল্য।
২০১৭ সালের ১৭-২০ জানুয়ারি বিশ্বের সবচেয়ে শান্তির দেশ হিসেবে পরিচিত সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ২০১৭ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ৪৭তম বার্ষিক সম্মেলন যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডব্লিউইএফের ৪৭ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের কোনো সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের অংশগ্রহণ এটাই প্রথম।
২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়ে উদ্বোধনী ভাষণেই মোটামুটি বুঝিয়ে দেন, কী করতে চলেছেন তিনি। তারই কিছু প্রতিফলন গোটা বছর ধরে আমরা অবলোকন করেছি। মোটামুটি একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ডের সারা বছর জুড়েই আলোচনায় রাখেন নিজেকে। ২৩ জানুয়ারি অফিসে বসেই এক নির্বাহী আদেশে আন্তঃপ্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্য চুক্তি (টিপিপি) থেকে তার দেশকে সরিয়ে নিয়ে আসেন। ২৭ জানুয়ারি নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সাতটি দেশের নাগরিকদের আমেরিকা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। বছরের একবারে শেষভাগে এসে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে উত্তাল করে তোলেন বিশ্ব পরিস্থিতি। শুধু তা-ই নয়, তেল আবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরেরও প্রস্তুতি নিতে বলেন তার প্রশাসনের লোকজনদের। বিশ্বনেতারা মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন। অবশ্য এর সপ্তাহখানেক পরে এক পাল্টা প্রস্তাবে ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের সংগঠন ওআইসি পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর কিছুদিন পরে জাতিসংঘ থেকেও বড় একধরনের চপেটাঘাত পায় ট্রাম্প প্রশাসন। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করে জাতিসংঘ। ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিপুল ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে একটি প্রস্তাব পাশ হয়। ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে উপস্থিত ছিল ১৭২টি রাষ্ট্র, যার মধ্যে ১২৮টি রাষ্ট্রই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জাতিগোষ্ঠীর উপর মায়ানমার সেনাবাহিনী নারকীয় অত্যাচার চালায়। শুধু তা-ই নয়, দশজনের নয়জনই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মায়ানমারে অনেকেই এই অত্যাচার নিপীড়নকে সমর্থন করে। মায়ানমারের সরকারি বার্তা সংস্থাগুলোর দাবি মোতাবেক, ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের আক্রমণে পুলিশ চেকপোস্টে ১২ পুলিশ নিহত হবার জের ধরেই শুরু হয় এই জাতিগত নিপীড়ন। নাফ নদী পেরিয়ে দলে দলে বাংলাদেশ পানে ছুটে আসছে অত্যাচারিত রোহিঙ্গারা। এই ন্যাক্কারজনক জাতিগোষ্ঠী নিধনে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সাং সুচির নির্লজ্জ নিশ্চুপ অবস্থান বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় তোলে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া ( ব্রেক্সিট) ছিল পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে ইউরোপের জন্য ২০১৭ সালের অন্যতম ধাক্কা। লিসবন চুক্তির ৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের যেকোনো দেশ চাইলে এই সংগঠন থেকে বের হয়ে যেতে পারবে। আর এই ধারার উপর ভিত্তি করে ৫২% ব্রিটিশ নাগরিক (১৭.৪ মিলিয়ন ভোটার) এই মর্মে রায় দেয় যে, তারা আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে থাকবে না।
২০১৭ সালকে বলা যায় সৌদি রাজতন্ত্রের জন্য এক ঝড়ের বছর। এ বছরের জুনে সৌদি বাদশাহ রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকারীর ক্রমধারায় এক পরিবর্তন ঘটান। তিনি ভাতিজা মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে তার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মনোনিত করেন; প্রকারান্তরে নিজ পুত্রকে তিনি সৌদি সিংহাসনের পরবর্তী বাদশাহ হিসেবে মনোনয়ন দেন।
জিম্বাবুয়ের স্বৈরশাসক রবার্ট মুগাবে ছিলেন বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক রাষ্ট্রপ্রধান। দীর্ঘ ৩৭ বছর তিনি জিম্বাবুয়ে শাসন করেছেন। অত্যাচারিত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ে নিজেও হয়েছিলেন অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য খেটেছেন জেল। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে আর অর্থের লোভে পরবর্তীকালে এই মানুষটিই হয়ে ওঠেন জিম্বাবুয়ের মানুষদের জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ।
উত্তর কোরিয়ার সর্বময় তরুণ নেতা ৩৩ বছর বয়সী কিম জং-উনের খামখেয়ালীর মাত্রা ছাড়িয়ে যায় গত ৩ সেপ্টেম্বরের বিকেলে। এদিন উত্তর কোরিয়া হাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষা চালায় বলে দাবি করে। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম কেসিএনএ দাবি করে যে, তাদের কাছে আগের চেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা আছে। আর এই সংবাদ প্রচারের কিছু পরেই যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-জরিপ অধিদপ্তর উত্তর কোরিয়ার পানগেয়ি-রি পারমাণবিক কেন্দ্রের কাছে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করে। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে এই ভূকম্পনের কারণ হিসেবে ষষ্ঠবারের মতো চালানো পারমাণবিক বোমার পরীক্ষাকে উল্লেখ করা হয়।
গত ২৯ নভেম্বর উত্তর কোরিয়া নতুন করে আরো একটি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। তাদের দাবি, এটি যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। এরই জের ধরে উত্তর কোরিয়ার উপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতিসংঘ। আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোয় গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতভাবে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুত করা এই নিষেধাজ্ঞা খসড়া প্রস্তাবে উত্তর কোরিয়ার দুই প্রধান ব্যবসায়িক অংশীদার রাশিয়া ও চীনসহ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি রাষ্ট্রের সকলেই পক্ষে ভোট প্রদান করে।
স্পেনের উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত কাতালোনিয়া প্রদেশটি দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার দাবি করে আসছিল। এ বছরের ৯ জুন কাতালোনিয়ার পার্লামেন্ট কর্তৃক স্বাধীনতা ইস্যুতে গণভোটের তারিখ হিসেবে ১ অক্টোবরকে চূড়ান্ত করা হয়। ৬ সেপ্টেম্বর এই নির্বাচনের বৈধতা প্রদানের অনুকূলে একটি আইনও পাস হয় তাদের পার্লামেন্টে।যথারীতি ১ অক্টোবর ভোট গ্রহণ শুরু হয়। মাত্র ৪৩.০৩ ভাগ ভোটার এতে অংশ নিলেও ভোটারদের ৯২.০১% (২০,৪৪,০৩৮ জন) স্বাধীনতার পক্ষে; অন্যদিকে মাত্র ৭.৯৮% (১,৭৭,৫৪৭ জন) এর বিপক্ষে ভোট দেয়।
অক্টোবরে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে দলটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন গণচীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। প্যারিস চুক্তি, আধুনিক চীন গঠন থেকে শুরু করে আরো অনেক যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত তাঁকে বিশ্বনেতৃত্বের আসনে বসিয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতির নানা সমীকরণে আগামীর সম্ভাবনা নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। ইতিমধ্যেই মার্কিন আদমশুমারি ব্যুরোর হিসাব অনুয়ায়ী ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারিতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৭ কোটি ৮৫ লাখ ২১ হাজার ২৮৩ জন বেড়ে ৭৪৪ কোটি ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৮৮১ জনে দাঁড়াবে। ২০১৭ সালের প্রথম দিন থেকে এ বৃদ্ধির হার ১.০৭ শতাংশ। হিসাব অনুযায়ী ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে বিশ্বব্যাপী প্রতি সেকেন্ডে ৪.৩ জন শিশু জন্ম নেবে এবং ১.৮ জনের মৃত্যু হবে। নতুন বছরে জন্ম নেয়া এবং অনাগত শিশুদের নিয়ে গড়ে উঠবে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব। কোনো সংঘাত, দ্বন্দ্ব এবং বিভেদ থাকবে না, এমন প্রত্যাশা নিয়ে ২০১৮ সালে ইতিবাচক বিশ্ব রাজনীতির আগমন ঘটুক এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।