অভিমত
মে দিবসকে সামনে রেখে যে কথা বলতেই হবে
গত তিন দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ আর এখন শুধু কৃষিনির্ভর দেশ নয়। পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশের জন্মের পরও আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত হতে পারেনি অনেক কাল। পাটের সুদিন হারিয়ে যাওয়ার পর আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছিল। আমরা যে শিল্প দ্রব্য উৎপাদন করব এবং কিছু কিছু পণ্য এক সময় রপ্তানি করব তা অনেকটা কল্পনার বিষয় ছিল।
এখন আর কল্পনা নয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে—উঠছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে কোনো পণ্য রপ্তানিও হচ্ছে। ক্রমে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকা বড় হচ্ছে। তবে রপ্তানির যাত্রা পথে সর্বপ্রথম পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বই ছিল চোখে পড়ার মতো। এখনো রপ্তানি শিল্পের অগ্রযাত্রায় পোশাক শিল্প এর অবস্থানটি দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে।
সারা বছর আমাদের কতটা মনে থাকে জানি না, তবে মে দিবস এলে অবধারিতভাবে সামনে চলে আসে এই প্রশ্নটি যে, যাদের শ্রম ও ঘামে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে আছে—সচল থাকছে তারা কি তাদের যোগ্য পারিশ্রমিক পাচ্ছে? যাপিত জীবনে তাঁদের নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারছে মালিক, সরকার এবং সুবিধাভোগী সমাজের মানুষ?
মধ্যযুগের ইউরোপের সামন্ত প্রথাকে একটি পিরামিড দিয়ে বোঝানো হয়। নাইট থেকে শুরু করে উপরে নানা মর্যাদার লর্ডের অবস্থান আর সর্বোচ্চে অবস্থান করতেন রাজা। অন্যদিকে গোটা উৎপাদন ব্যবস্থা যাদের শ্রম ও ঘাম জড়ানো সেই কৃষক সব অধিকার হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকত সর্বনিম্নে। শুধু মধ্যযুগে কেন—প্রচীন যুগে পৃথিবীর অনেক সভ্যতা—বড় করে বললে রোমান সভ্যতার অর্থনৈতিক ভিত্তি তো গড়ে উঠেছিল দাস শ্রমের ওপরই। কিন্তু দাসদের ভাগ্য ছিল মানবেতর জীবন বয়ে বেড়ানো। এমন সব নিপীড়নের ফল ভালো হয় না। বঞ্চিত-পীড়িত দাসরাও এক সময় ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাস বিদ্রোহ এর প্রমাণ।
ইতিহাসের প্রেক্ষিত টানতে হলো এ জন্য যে আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের এমন বিকাশমান যুগে শ্রমিক স্বার্থ যখন রক্ষা করার জন্য মালিক পক্ষ সহানুভূতিশীল থাকে না তখন নানামুখী দুশ্চিন্তা ভর করে। অনেক আন্দোলনের পরে এখন পোশাক শিল্প কারখানায় কিছুটা সহনযোগ্য বেতন কাঠামো তৈরি হয়েছে। তবে তা কি যথেষ্ট যৌক্তিক পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছে? বৈশ্বিক দুঃসময়ের কারণে মালিকপক্ষ প্রায়ই হাহাকার করে। হয়তো তাদের লাভের অঙ্ক কিছুটা কমে গেছে। তারপর যা থাকছে তা তেমন কম কি? বড় ফ্যাক্টরির মালিকদের প্রায়ই দেখা যায় ব্যবসা বাড়াতে। কারখানার সংখ্যা বাড়ে অথবা আয়তন বড় হয়। তাহলে লভ্যাংশের একটি অংশ তো শ্রমিকরা পেতেই পারে। এতে তাদের জীবনমান একটু বাড়ে বইকি! বাস্তবতা হচ্ছে সস্তা মজুরিতে শ্রম বিক্রি এ দেশের শ্রমিকদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের তাগিদ দিলেও দাবি দাওয়া আর আন্দোলনের ভয়ে মালিকরা সে পথ মাড়াতে চান না। এখানে আমার ধারণা একটু হিসাবের ভুল রয়েছে। উপমহাদেশে কোম্পানি শাসনের অবসানের প্রর প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ শাসন। ব্রিটিশ-ভারতীয় সাম্রাজ্য ছিল বহুভাষিক এবং নানা সংস্কৃতির মানুষের রাজ্য-সমন্বয়। তাই সব অঞ্চলকে একসাথে নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ ছিল না। ফলে দূরদর্শী ইংরেজ শাসকরা বুঝতে পারল ভারতীয়দের জন্য যদি একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে দেওয়া যায় তবে চারদিক থেকে নানা দাবি ওঠার সুযোগ থাকবে না। সবার পক্ষ থেকে কথা বলার দায়িত্ব থাকবে একমাত্র সেই রাজনৈতিক দলেরই। এই বিবেচনায় ব্রিটিশ সিভেলিয়ান অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম সাহেবকে কাজে লাগান হলো। তিনি ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা করে ১৮৮৫ সালে নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেস নামে রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম দিলেন। আমাদেরও মনে হয় শ্রমিক অসন্তোষ সম্পর্কে আগে থেকে বোঝা সম্ভব নিজেদের শ্রমিক সংগঠন থাকলে। একে যদি সুনিয়ন্ত্রণ করা যায় তবে লাভ বই ক্ষতি হওয়ার সুযোগ কম। এতে শ্রমিকেরও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ থাকে। মালিক-শ্রমিক উভয়ের ভালো থাকার শর্তই হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর উভয়ের দায়িত্ব কর্তব্য আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করা।
আমি জেনে অবাক হই যেখানে সরকারি বেতন স্কেল একটি সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছেছে সেখানে একটি বড় পোশাক কারখানার উচ্চ শিক্ষিত শাখা ম্যানেজার সাকুল্যে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন পান (ব্যতিক্রম বাদে)। আমি জানি না এসবের কোনো নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আছে কি না।
শুধু পোশাক কারখানা নয় যেকোনো বেসরকারি শিল্প কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারীরা এখনো মানসম্পন্ন পারিশ্রমিকের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারছে না। ১ মে—মে দিবসের ডাকে প্রতি বছর আমরা কীভাবে সাড়া দেব? একি শুধু দিবস তর্পণ? সেই কোন কালে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শিকাগোর শ্রমিকরা রক্ত দিয়ে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল এর স্মৃতিতে কি শুধু শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদিত হবে? না এই ইতিহাস থেকে আমরা উদ্দীপ্ত হবো? শ্রমিক অধিকার অর্থ শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি আর জীবনের নিরাপত্তা নয়—প্রতিষ্ঠানের প্রতি কর্তব্য পালনেরও অঙ্গীকার। এই বোধ যদি সক্রিয় থাকে এবং উদ্দীপনা তৈরি হয় তবেই মে দিবসকে স্মরণ করা যথার্থ হবে।