স্মরণ
আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গীত আর অমলিন মুগ্ধতা
অজস্র সঙ্গীত অনুরাগীদের বিষাদগ্রস্ত করে হঠাৎই বিদায় নিলেন বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীতের উঁচু মান সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে সঙ্গীতশিল্পীদের অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইয়ুব বাচ্চু তাঁদের একজন। মূলত একজন গিটারিস্ট হিসেবে তিনি ব্যান্ড সঙ্গীত শুরু করেন, এবং বাংলাদেশের সবসময়ের সবচেয়ে খ্যাতিমান গিটার শিল্পীদের একজন হিসেবে তিনি স্বীকৃত। পরবর্তী সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এলআরবি ব্যান্ড। তখন থেকেই গিটারের সুরের পাশাপাশি একজন গায়ক হিসেবেও তিনি দর্শকদের মন জয় করেছেন। আইয়ুব বাচ্চুকে যখন প্রথম দেখি টেলিভিশনে সেই স্মৃতিটিও মনে পড়ে। তখন গত শতকের আশির দশকের শুরুর দিক। আইয়ুব বাচ্চু সেই সময়ের তুমুল জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলসের লিড গিটারিস্ট।
বিটিভিতে মাঝেমধ্যে দেখানো হতো সোলসের কিছু গান ― ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে, ওহ্ সে তো মুখ খোলেনি,’ ‘খুঁজিস যাহারে, বনে প্রান্তরে, নয়ন মেলে দ্যাখ্, সে থাকে অন্তরে।’ তপন চৌধুরী গাইতেন গানগুলো। পাশে দেখা যেত নকীব খান, নাসিম আলী খান, পিলু খান, রনি বড়ুয়ার মতো নামকরা সঙ্গীতশিল্পীদের। আর অবশ্যই দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নিতেন ভোকালিস্টের ঠিক পাশেই গিটার হাতে চুপচাপ দাঁড়ানো আইয়ুব বাচ্চু। মজবুত শারীরিক গঠন, ফ্যাশান দুরস্ত পোশাক, আর দারুণ ঝাঁকড়া চুল আইয়ুব বাচ্চুর চেহারায় নিয়ে এসেছিল ভিন্নতা। আর তাঁর গিটার বাজানোর মুনশিয়ানার মাধ্যমেও আইয়ুব বাচ্চু দ্রুতই আলাদা অবস্থান করে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত ভুবনে। রক সঙ্গীত ঘরানার একজন গিটারিস্ট হিসেবে তিনি যেমন প্রশংসা পেয়েছেন, তেমনি ব্লুজ সঙ্গীতের সুর সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তাঁর সাফল্য ছিল অনবদ্য। ২০১৫ সালে ঢাকায় যে জ্যাজ-ব্লুজ কনসার্ট হয়েছিল সেখানে আইয়ুব বাচ্চুর গিটারের সুর ব্লুজ সঙ্গীতের অপূর্ব মুর্চ্ছনায় মোহনীয় করে তুলেছিল কনসার্ট প্রাঙ্গণ।
সেই কনসার্টে জন ম্যাকলফলিনের মতো বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্লুজ সঙ্গীতশিল্পীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। যখন আইয়ুব বাচ্চু তাঁর সহশিল্পীদের নিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করলেন, তাঁর গিটারের সুরের মাধুর্য অভিভূত করে তুলেছিল দর্শকদের। সেই সন্ধ্যায় সেখানে বসে উপভোগ করছিলাম সেই সুর। মনে হচ্ছিল সেদিন অংশ নেওয়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গীতশিল্পীর চেয়ে আইয়ুব বাচ্চুর গিটারের সুর আর গানগুলো কোনো অংশে কম আকর্ষণীয় তো নয়ই, বরং কখনো যেন তা হয়ে উঠছিল অন্যদের বাজানো সুরের চেয়েও বেশি সুন্দর।
সোলসে থাকার সময়ই আইয়ুব বাচ্চু হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত জগতের গুরুত্বপূর্ণ তারকা। আর সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাঁর গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায় নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তাঁর নেতৃত্বে এলআরবি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীতের যে প্রশংসনীয় মান ছিল তারই ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই চিত্তাকর্ষক সঙ্গীত সৃষ্টির মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিভিন্ন নতুন ব্যান্ড যেমন উইনিং, ওয়ারফেজ, প্রমিথিউস, নোভা, সাডেন, রক স্ট্রাটা, ডিফারেন্ট টাচ, ফেইথ, আর্ক, অবসকিওর প্রভৃতি। সেই সময়টা ছিল বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীতের এক সোনালি সময়। যেমন নান্দনিকভাবে আকর্ষণীয় বিভিন্ন গান এই সময় রচিত হয়েছিল, তেমনি দর্শকদের মধ্যে দেশের ব্যান্ডগুলোর গান শোনার প্রতি তৈরি হয়েছিল তুমুল আগ্রহ। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই ঢাকায় ওপেন এয়ার কনসার্ট হতে থাকে। এমন এক একটি কনসার্টে অংশগ্রহণ করত দেশের নামকরা বিভিন্ন ব্যান্ড। আর বহু দর্শকের সমাগমে আর উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠত কনসার্টগুলো। এই সময়ই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এলআরবি এবং আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া বিভিন্ন গানের প্রতি দর্শকদের গভীর আকর্ষণের কারণে ব্যান্ডটি দ্রুত দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যান্ড হয়ে ওঠে।
দেখা যেত এলআরবি কোনো কনসার্টে মঞ্চে আসা মাত্রই দর্শকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে গভীর উচ্ছ্বাস। দর্শকদের এমন গভীর আকর্ষণ মূলত তৈরি হয়েছিল আইয়ুব বাচ্চুকে ঘিরেই। তাঁর গিটারের সুর, কণ্ঠ, এবং গান গাওয়ার ভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র আর এই ভিন্নতা দর্শকদের আকৃষ্ট করেছিল সহজেই। আইয়ুব বাচ্চু যে সময় বড় হয়ে উঠছিলেন তখন আমাদের দেশের অনেক তরুণই পাশ্চাত্যের রক আর পপ সঙ্গীতের ভক্ত ছিলেন। দ্য বিটল্স, রোলিং স্টোন্স, জিমি হেনড্রিক্স, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটনের গান থেকে শুরু করে সত্তর-আশির দশকের লেড জেপেলিন, ডিপ পার্পল, নিরভানা, ডায়ার স্ট্রেইট্স, গানস অ্যান্ড রোজেস, পিঙ্ক ফ্লয়েড, দ্য র্ডোস, স্করপিয়নস প্রভৃতি ব্যান্ডের গান সেই ইউটিউববিহীন যুগেই ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজত বিভিন্ন বাড়িতে। রেডিওতে ওয়ার্ল্ড মিউজিক অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে শোনা যেত এসব গান। আর ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে রেইনবো আর অন্য দুটি দোকানে পাওয়া যেত পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যান্ডের লং প্লেইং রেকর্ড। আইয়ুব বাচ্চুর গানে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের দুটি ধারা রক আর ব্লুজের প্রভাব আমরা দেখেছি। বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে এমন প্রভাব যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে যে গানগুলো তৈরি হয়েছে তা দর্শকরা পছন্দ করেছে। কয়েক দশক ধরেই তরুণ-তরুণীরা বারবার শুনেছে আইয়ুব বাচ্চুর বিভিন্ন গান। এমন এক একটি গান যেন স্মৃতি ফিরিয়ে আনে বিশেষ কোনো সময়ের যখন সেই গানটি শুনেছিলাম প্রথমবার।
আইয়ুব বাচ্চুর বিভিন্ন গানই অজস্র দর্শকের অত্যন্ত প্রিয়। ‘চলো বদলে যাই’ গানটির কথাগুলো ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে/সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম/ কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি/কীভাবে এত বদলে গেছি এই আমি/ও বুকের সব কষ্ট দুহাতে সরিয়ে/চলো বদলে যাই’ গানটি বিষণ্নতার অনুভব যেমন তুলে ধরে, সেই সাথে প্রকাশ করে নতুন কোনো আশাও। যে আশা নিয়েই বেঁচে থাকে মানুষ, এগিয়ে যায় সামনের দিকে, খুঁজে নেয় এবং ফিরে পায় হারিয়ে যাওয়া আনন্দ। তরুণ-তরুণীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল গানটি কারণ জীবনের এক পরিচিত অনুভূতিই উঠে এসেছে এখানে খুব সহজ ভাষায়, মন স্পর্শ করে যাওয়া সুরে। আবার ‘নীল নয়না’ গানটিতে ‘নীল নয়না/খুঁজে দ্যাখো না/ওই চোখ দুটো আমার তোমাকে খোঁজে/ফেরারি এই মন আমার/ফিরে আসে বারবার/তোমাকে পাবার আশায়/এখানে’ গানটিতে ব্লুজের কিছুটা দ্রুত তালের সুর মনে নিয়ে আসে স্নিগ্ধ এক অনুভূতি যা শ্রোতার মন ভালো করে তোলে সঙ্গে সঙ্গেই। আবার ‘ঘুমন্ত শহরে’ গানটিতে ‘ঘুমন্ত শহরে রুপালি রাতে/স্বপ্নের নীল চাদর বিছিয়ে/আমি আছি আছি তোমার স্মৃতিতে/তুমি আমি একই শহরে/তব্ওু একাকী ভিন্ন গ্রহে’ এই কথাগুলো তুলে ধরে মনের গভীরের এক বিষাদময় অনুভূতি। রাতের নির্জনতা আর একাকীত্বে সেই বিষাদ যেন মনকে আরো বেশি ছুঁয়ে যায়। আবার ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ গানটিতে ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে/মায়াবী সন্ধ্যায়/চাঁদ জাগা এক রাতে/একটি কিশোর ছেলে/একাকী স্বপ্ন দেখে/হাসি আর গানে সুখের ছবি আঁকে/আহা কী যে সুখ’ কথাগুলো আর সেই সাথে গিটারের আনন্দময় সুর জীবনের স্বপ্নগুলো নিয়ে ভাবতে অনুপ্রাণিত করে শ্রোতাকে। তবে আইয়ুব বাচ্চুর গানে প্রায়ই লক্ষ করা যায় বিষণ্নতার একটি অনুভব। তাঁর আরেকটি দর্শকপ্রিয় গান ‘হাসতে দেখ, গাইতে দেখ/অনেক কথায় মুখর আমায় দেখো/দেখ না কেউ হাসির শেষে নীরবতা’ আবারও প্রকাশ করে বিমর্ষতা। কেন তাঁর বিভিন্ন গানে এসেছে বিষাদময়তা, তা নিয়ে কি আইয়ুব বাচ্চু কখনো কথা বলেছেন? আমার তা জানা নেই এখনো। তাই কেবল ধারণা করতে পারি হয়তো বিষাদমগ্নতা তাঁকে স্পর্শ করত বেশি। যখন তিনি গান করতেন এবং কথা বলতেন তখনো বেশির ভাগ সময়ই কিন্তু দেখা যেত তাঁকে ঘিরে আছে গাম্ভীর্য। এই গাম্ভীর্য প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর সঙ্গীতেও। কিন্তু তার ফলে আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গীত এবং গিটারের সুর পেয়েছে স্বতন্ত্র এক মাত্রা।
আর হেমন্তের এক মলিন রোদের সকালে হঠাৎই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন এই গুণী সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর এই অকালপ্রস্থান বিষণ্ন আর শোকগ্রস্ত করে তুলেছে তাঁর ভক্তদের, ব্যান্ড সঙ্গীতের অনুরাগী মানুষদের। গত কয়েক দশকে যারা কৈশোর থেকে তারুণ্যে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের জীবনে গান শোনার আনন্দের একটি অন্যতম উৎস ছিল আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গীত। তাঁর গানগুলো জড়িয়ে আছে কয়েকটি প্রজন্মের কৈশোর এবং তারুণ্যের স্বপ্নময় স্মৃতিগুলোর সঙ্গে। প্রিয় সেই বিভিন্ন গানের সুর আমাদের মনে ফিরিয়ে আনে পুরোনো দিনের স্মৃতি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের পুরোনো স্মৃতি যখন মনে করি তখন অবশ্যই মনে পড়ে যায় আইয়ুব বাচ্চুর গান। এই প্রতিভাশালী শিল্পীর গান যে আনন্দ আর আকর্ষণ অজস্র দর্শকের জন্য সৃষ্টি করেছে, সেই মুগ্ধতা কোনোদিনও মলিন হবে না, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনবে আগামী প্রজন্মের সঙ্গীত অনুরাগীরাও কারণ তাঁর গান জীবনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন অনুভূতিই তুলে ধরেছে। আর তাঁর গানগুলোতে শুনতে পাওয়া তাঁর আবেগময় উচ্চারণ এবং তাঁর গিটারের অনুপম সুর মানুষের মন স্পর্শ করে যাবে, চিরদিন।
লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়