রাজনীতি
ইশতেহারের ভালো-মন্দ
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এরইমধ্যে তাদের প্রতিশ্রুতিসমৃদ্ধ নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করে জনগণকে শুনিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ‘দিনবদলের সনদ’ ও ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’-এর পর আসন্ন ৩০ ডিসম্বরের নির্বাচনের ইশতেহারের শিরোনাম দিয়েছে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। প্রতিটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থান, গত ১০ বছরের অর্জন এবং আগামী দিনের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ধরে সাজানো হয়েছে ৮০ পৃষ্ঠার এই ইশতেহার। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপি আলাদাভাবে ইশতেহার ঘোষণা করেছে। তাদের আলাদা ইশতেহার প্রসঙ্গে নানা মহল থেকে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হলো বিগত তিন মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০১৩, এবং ২০১৪-২০১৮) কী করেছে এবং আগামী পাঁচ বছরে (২০১৯-২০২৩) কী করতে চায়।
অন্যদিকে, বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে আওয়ামী লীগের ১০ বছরের কার্যক্রমের এক ধরনের সমালোচনা এবং ত্রুটি সংশোধনময় হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। এরইমধ্যে বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের গ্রহণকৃত নানা উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ধারাবাহিক কার্যক্রম হিসেবে তাদের ইশতেহারটি উপস্থাপিত হয়েছে। বলা যেতে পারে, এই ইশতেহার আগামী দিনের উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিক রোডম্যাপ।
অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে বিশেষ চমক মনে হয়েছে চাকরিতে প্রবেশে কোনো বয়সসীমা না রাখা। আবার বিএনপির ইশতেহারেও বলা হয়েছে শর্ত সাপেক্ষে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা না থাকা। এ রকম বেশ কিছু বিষয়ে শর্তেরও কথা বলা হয়েছে। আসলে এ বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া কঠিন যে, শর্ত বলতে তারা কী বুঝাতে চেয়েছে। আবার তাদের ইশতেহার দেখে এটাও মনে হয়েছে যে, তারা ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের গ্রহণকৃত অনেক কার্যক্রমকেই ঢেলে সাজানোর নামে বন্ধ করে দিতে পারে। ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে থাকা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একদিন পর দলের যে ইশতেহার দেন, তাতে জোটের ইশতেহারের সঙ্গে অনেক মিল পাওয়া গেলেও যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচারের কোনো প্রসঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে মনে হয়েছে যে, যেহেতু একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের বেশ কয়েকজনের স্বজনদের প্রার্থী করেছে সেহেতু এ বিষয়ে তারা কিছু বলতে চান না।
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াত নিবন্ধন হারানোয় দলটির নেতাদের ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করার সুযোগও দিয়েছে বিএনপি। বিএনপি নেতারা এত দিন বলে আসছিলেন, যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তারা ক্ষমতায় গেলে ‘প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচার করবেন। এখানে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী বলতে তারা কী বুঝাতে চান সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত কেউই পরিষ্কার হতে পারেনি।
দল ক্ষমতায় না গেলে দেশ ও জাতির জন্য তাদের কেমন ভূমিকা থাকবে সে বিষয়ে কোনো দলই প্রতিশ্রুতি দেয়নি ইশতেহারে। এমনকি বিরোধী দলে থাকলে তাদের কেমন দায়িত্বশীল আচরণ হবে সে বিষয়ে কোনো রূপরেখা উপস্থাপন করেনি রাজনৈতিক দলগুলো। মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা-পরবর্তী কার্যক্রম এবং প্রতিশ্রুতির রোডম্যাপভিত্তিক একটি লিখিত দলিল। লিখিত দলিলের পাশাপাশি মুখে মুখেও নানা প্রতিশ্রুতির ঝুলি নিয়ে প্রার্থীরা সাধারণ জনগণকে আকৃষ্ট করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি বিরোধী দলেরও বিশেষ ভূমিকা থাকে রাষ্ট্রের উন্নয়নে। কাজেই বিরোধী দল হিসেবেও রাজনৈতিক দলের করণীয় ইশতেহারে থাকার ন্যায্যতা রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ঘোষিত ইশতেহার বাস্তবায়নে ক্ষেত্রে নেতৃত্বেও একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। নেতৃত্ব যথাযথ হলে ইশতেহার বাস্তবায়ন সহজ হয়। আবার নেতৃত্ব দুর্নীতিপরায়ন হলে ইশতেহার বাস্তবায়ন দূরে থাক, সবকিছুই অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার সুযোগ থাকে। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের ইশতেহার বাস্তবায়নের নেতৃত্বে থাকবে শেখ হাসিনা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগের ইশতেহার বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট কিংবা বিএনপির ইশতেহার বাস্তবায়নে মূল নেতৃত্বে কে থাকবেন সেটি এখনো দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার নয়। অর্থাৎ তারা ক্ষমতায় গেলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন এ বিষয়ে তাত্ত্বিক বক্তব্যের বাইরে কোনো সম্ভাবনা চোখে পড়েনি।
নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক সময় জনগণের জন্য চমক থাকে। এবারও রাজনৈতিক দলগুলো যথেষ্ট চমক দিয়েই ইশতেহার দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বর্ণিত চমকগুলো যদি রাজনৈতিক দলগুলো যথাযথভাবে মনে রাখতো তাহলে দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনে আর কোনো সমস্যা থাকতো না। সকল ইশতেহারেই অভিন্ন একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেটি হলো জনগণের উন্নয়নের মাধ্যমে সমগ্র রাজনৈতিক কাঠামোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
যেসব দল ইশতেহার প্রদান করেছে সেগুলোর প্রতিটি দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসবে না এটা খুব স্বাভাবিক। তবে ক্ষমতায় না আসলেও কোনো কোনো দল বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবে। গণতন্ত্রে বিরোধী দলের অস্তিত্ব সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। আর বিরোধী দল হিসেবে একটি রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্র শুদ্ধিকরণ এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা থাকে। বিশেষ করে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় বিরোধী দলের কোনো বিকল্প নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্য বজায় রাখতে সংসদে ও সংসদের বাইরে বিরোধী দলের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কাজেই যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচেন প্রতিদন্দ্বিতা করছে এবং ইশতেহার ঘোষণা করেছে, সেসব দল ক্ষমতায় আসতে না পারলেও ইশতেহারে প্রদত্ত মৌলিক প্রতিশ্রুতির দিকে সম্মান রেখে ইতিবাচক রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া উচিত। কারণ কোনো রাজনৈতিক দল একবার ক্ষমতায় যেতে না পারলেও পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ থাকে। এ লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে দেশের ইতিবাচক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর একমাত্র ব্রত হওয়া উচিত।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।