প্যারিস হামলা : নিরাপদ নয় কেউই

ফ্রান্সের ‘দুঃস্বপ্নের রাতে’ জঙ্গিরা যখন শরীরে বোমা বেঁধে, আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি করতে করতে, নির্বিচারে মানুষ মারছিল হতভাগ্য নিহতদের কেউ তখন গান শুনছিল, কেউ খেলা দেখছিল, কেউ বা আবার রেস্তোরাঁয় খাবার উপভোগ করছিল। ঘটনার পর মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) খুব গর্বভরে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। এক অনলাইন বিবৃতিতে জঙ্গি সংগঠনটি দাবি করে, প্যারিসে হামলা নিয়ে অনেক দিন ধরেই পরিকল্পনা চলেছে এবং আটজন জিহাদি শরীরে বিস্ফোরক বেঁধে ও অস্ত্র হাতে হামলা চালিয়েছে। বিবৃতিতে ওই জঙ্গি সংগঠনটি আরো জানায়, ফ্রান্স এখনো আইএসের ‘শীর্ষ লক্ষ্যবস্তু’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিসের ওপর এত ভয়ংকর আঘাত এই প্রথম। হামলার পর শনিবার সকালে এক টেলিভিশন ভাষণে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ আইএসকে দায়ী করে বলেছেন, ‘এটা যুদ্ধ। জিহাদি সেনাদের আক্রমণ। নির্মমভাবে এর পাল্টা আঘাত হানা হবে।’ সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জন্য দেশে জরুরি অবস্থাও জারি করেছেন প্রেসিডেন্ট। ভাষণে বলেছেন, নির্মমভাবে দমন করা হবে জঙ্গিদের। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেন তিনি ।
ওই দিনই তারিখহীন এক ভিডিওতে আইএস ফ্রান্সের ওপর আরো আঘাত হানার ডাক দেয়। কারণ, সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে অভিযানে যোগ দিয়েছে ফ্রান্স। ভিডিওতে ফ্রান্স এবং এর অনুগামী অন্য সব দেশকে তারা আরো বহু লাশের গন্ধে ভরিয়ে দেবে বলেও হুমকি দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এই জঙ্গি সংগঠনটি ইসলামী ‘শরিয়া’ মেনে পৃথিবীতে ‘স্বর্গরাজ্য’ বানাতে চায়। সেই ‘স্বর্গরাজ্যের’ স্পষ্ট ভৌগোলিক সীমা এরা এরই মধ্যেই ঠিক করেছে। কিন্তু ঠিক করা সেই স্বর্গরাজ্যের বাইরে যে তারা কোনো নাশকতা করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা কিন্তু তারা দেয়নি। ফ্রান্সে এই নাশকতা চালানোর পর স্বীকারোক্তিতে তারা যুক্তি দিয়ে এই হামলাকে ‘মহিমান্বিতও’ করেছে।
এই জঙ্গি সংগঠনটির দাবি অনুযায়ী, সিরিয়ায় ফ্রান্স আইএসের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়েছে, তাই ফ্রান্সকে আক্রমণ করে তাদের সাধারণ মানুষকে খুন করা যাবে। আবার কোরো রাষ্ট্র যদি সৈন্য নাও পাঠায়, কিন্তু এই জঙ্গি দলটি মনে করে ওই রাষ্ট্র ‘ইসলামবিরোধী কার্যক্রমকে’ প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাহলেও তারা রাষ্ট্রটির বিপক্ষে যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এর মানে হলো, কেবল ‘স্বর্গরাজ্যের’ সীমানাতেই নয়, বরং যদি কেউ আদর্শিক সীমারেখায়ও বাধা দিতে আসে তাহলেও তার রেহাই মিলবে না। সংক্ষেপে বলা যায়, সারা পৃথিবীতেই যেখানে খুশি নিরীহ মানুষকে খুন করা হবে। আর কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই নিরস্ত্র মানুষদের মারার এই কাপুরুষোচিত কাজকে বীরত্বসূচক ‘আদর্শিক কাজ’ বলে প্রচার করা হবে।
ফ্রান্সের এই নাশকতার ঘটনার মাত্র একদিন আগে মার্কিন সেনারা সিরিয়ায় ‘জিহাদি জন’কে হত্যা করে বিশ্বগণমাধ্যমে সেটি প্রচার করছিল। এই জিহাদি জন ছিলেন যুক্তরাজ্যের এক নাগরিক, যিনি আইএসে যোগ দিয়ে বহু বন্দিকে খুন করেছিলেন। বন্দিদের কাটা মাথা সঙ্গে নিয়ে তাঁর অনেক ভিডিও ও ছবি প্রকাশ করা হয়েছে আইএসের প্রচারমাধ্যমে। সেখানে দেখা গেছে, উচ্চারণ এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যে জিহাদি জন একজন পুরোদস্তুর ব্রিটিশ। কিন্তু তাঁর অবস্থান ছিল ‘ইসলামী উগ্রবাদে’র পক্ষে। এর মানে হলো, ক্রমশ আইএসের সদস্য ও সমর্থকেরা দেশ বা বর্ণের সীমারেখাকে অতিক্রম করে গেছেন। একেই সম্ভবত বলা হয় ‘জঙ্গিবাদের বিশ্বায়ন’।
ফ্রান্সে এই বর্বর হামলার খবর শুনে সারা পৃথিবীর মানুষ হয়তো চমকে উঠেছে। অনেকেই হয়তো ভাবছে ফ্রান্স তো সিরিয়াবিরোধী যুদ্ধে সেনা পাঠিয়েছিল, তাই হয়তো তাদের পালা এলো। কিন্তু অনেকেই আবার এটিও ভাবছে, এই বর্বর জঙ্গিদের হাতে কেউই নিরাপদ নয়। যে কোনো দিন আমার দেশের, আমার এলাকায় হামলার পালা আসবে। আর এই ভয় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়াতেই উগ্রপন্থা এবং উগ্রপন্থীদের প্রকৃত জয়। নির্বিচার এই হিংসা ও ভয়ের আবহ তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে যে, তাদের নিয়মের ব্যতিক্রম হলেই এক নির্দেশেই থেমে যেতে পারে খ্যাতি ও সাফল্যের চূড়ায় ওঠা কোনো দেশ। মানুষের প্রাণ কেবল প্রাকৃতিক নিয়ম বা দুর্ঘটনায় নয়, থমকে যেতে পারে জঙ্গিদের অঙ্গুলিহেলনেও।
জঙ্গিবাদের এই সময়ে এসে পৃথিবী জুড়ে মাত্র কয়েক বছর আগেও পশ্চিমা বিশ্বে এক রকম নিশ্চিন্ত পরিবেশ ছিল, সেটি বদলে গেছে রাতারাতি। বিভিন্ন বিমানবন্দরে ঘুরলে সেটি স্পষ্ট বোঝা যায়। পৃথিবীব্যাপী এখন অচেনা মানুষ দেখলে, মানুষের প্রথম যে কথাটি মনে আসে সেটি হলো ‘সন্দেহ’। কোনো মনীষীর কথায় ছোটবেলা শেখানো হয়েছিল, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। আর এই যুগে এসে হয়তো শেখানো হতে পারে, সন্দেহ হারানো নির্বুদ্ধিতা। কারণ সন্দেহভাজন ওই মানুষটিকে তল্লাশিতে একটু ফাঁকি পড়লে প্রাণ হারাতে হবে বেঘোরে।
ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের নাগরিক ছাড়া অন্যদের দেশে ঢুকতে দিতে এমন সব শর্ত আরোপ করে চলছে, যা কেবল অপমানজনকই নয় বরং মানবাধিকারের লঙ্ঘনও। দেশটির মানবাধিকারকর্মীদের দাবি, সতর্কতার নামে মানুষকে কেবল নিগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সভ্য নামে পরিচিত পশ্চিমা দেশগুলোতেও কেবল অনুমানের বশে নিরপরাধ মানুষকে খুন করে চলছে পুলিশ।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের পরও বিশ্বব্যাপী এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। আর প্যারিস হামলার পরও বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের তুমুল সতর্কতার ও প্রবল ভীতির মধ্যে একটি অযৌক্তিক কারণে প্রতি-আক্রমণের একটি জিঘাংসা পশ্চিমা দেশগুলোর আচরণে দেখা যাচ্ছে। শুধু রাষ্ট্রপ্রধান ও নীতিনির্ধারকদের আচরণই নয়, একটু অন্য রকম দেখতে, ভিন্ন ফ্যাশন- অন্য রকম পোশাক পরা মানুষকে নিরাপত্তার নামে আটক করে নিপীড়ন করছে রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো। ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন পোশাকের মানুষদের পশ্চিমা সাধারণ মানুষও দেখছে ভয়ের চোখে। বিশ্বব্যাপী এই অবিশ্বাস ও প্রতিশোধস্পৃহার বিষ ছড়িয়ে দিতে পারা, এটাই সম্ভবত জঙ্গিবাদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব আর মানবতার বড় পরাজয়।
পিটার বেকার : নিউইয়র্ক টাইমসের হোয়াইট হাউসবিষয়ক সংবাদদাতা পিটার বেকার একজন মার্কিন রাজনৈতিক লেখক। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ বিষয়ে তাঁর রাজনৈতিক কলাম নিউইয়র্ক টাইম ম্যাগাজিন ও টাইম ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হয়।