খোলা মনে
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা!
লেখার শিরোনামে দুটি শব্দের পর ঠিক কী বসাব বুঝতে পারছি না। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কোথায়? প্রশ্নবিদ্ধ? নাকি ঝুঁকিতে বা অন্যকিছু। ঠিক কোন শব্দটা বসালে সেটা যুৎসই হবে তা বুঝতে না পেরে বিদগ্ধ পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম। ছেলেবেলায় নকুল কুমার বিশ্বাসের একটা গান শুনেছিলাম, গানটি এমন, ‘যদি মন্দির আর মসজিদে গিয়ে জুতা চুরি যায়, দয়াল তোমায় ডাকবো আমি কেমন করে নির্জন-নিরালায়।’ মসজিদ-মন্দিরে জুতা চুরি নিয়ে বেশ হাস্যরসও রয়েছে। এর পর থেকে সম্ভবত প্রতিটি মন্দিরে বা কোনো কোনো মসজিদে টাকার বিনিময়ে টোকেন সিস্টেম করে জুতা রাখার নিয়ম চালু হয়। ধান ভানতে শিবের গীত!
জন্মের পর থেকে দেখে আসছি পাকিস্তানে মসজিদে বোমা হামলা চলে একের পর এক। ৫০-৬০ জন মানুষের মৃত্যু যেন কিছুই না। আমরা হাসলাম। আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হলো। সোভিয়েতের পর মার্কিনরা এলো। ১৯৯৬ সালে তালেবানরা আরো অগ্রসর হলো। এর পর থেকে গেল কয়েক বছরে একের পর এক ধ্বংস করত লাগল ঐতিহাসিক স্থাপনা। গুঁড়িয়ে দিতে লাগল হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য-ঐতিহাসিক স্থাপনা। মসজিদে মসজিদে হামলা তো নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হলো। ১৪ ডিসেম্বর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক লেখায় জানা যায় (সেটি নেওয়া হয় ভারতের পত্রিকা সিটিজেন থেকে) বর্তমান আফগানিস্তানের যে চিত্র ৫০ ও ৬০-এর দশকে ছিল এর উল্টো চিত্র। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে সেখানে নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। ৮৫ ভাগ নারীর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। অথচ ৬০ এর দশকে সেখানে নারীরা প্রকাশ্যে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, মিনিস্কার্ট পরতেন, পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে বাসে যেতেন, অফিসে কাজ করতেন বা বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন, সংগীত চর্চা করতেন। পত্রিকাটি এর সপক্ষে বেশ কিছু ছবিও প্রকাশ করেছে।
বলছি না আমাদের দেশে তালেবান আছে, আইএস আছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, এসবের অস্তিত্ব বাংলাদেশে নেই। কিন্তু এটা তো ঠিক জেএমবি আছে, হরকাতুল জেহাদ আছে, আহসান-আল-ইসলাম আছে, উগ্রপন্থী জামায়াত-শিবির আছে, হিযবুত তাহরীর আছে, হেফাজতে ইসলামসহ নাম না জানা আরো উগ্রবাদী সংগঠন আছে। এরাই তো একসময় স্লোগান দিয়েছিল, ‘আমরা সবাই তালেবান-বাংলা হবে আফগান।’ তাই সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। ধীরে চলো নীতি বাদ দিয়ে কঠোর সিদ্ধান্তে যেতে হবে আমাদের। কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করলে সেটি মনে আসাই স্বাভাবিক। ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাতে গোপীবাগের বাসায় কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুকীসহ ছয়জনকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত বছরের ২৭ আগস্ট পূর্ব রাজাবাজারে মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়। তবে ২০১৫ সালের শেষের দিকে এসে যেটি প্রকট আকার ধারণ করেছে তা হলো, মসজিদ মন্দিরে বা ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর হামলা। ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের শেরশাহ বাংলাবাজারে ‘ল্যাংটা ফকির’ নামে পরিচিত ফকির রহমত উল্লাহ ও তাঁর খাদেম আবদুল কাদেরকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ৫ অক্টোবর পাবনার ঈশ্বরদীতে ধর্মযাজক লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২৩ অক্টোবর হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় হামলা চালানো হলে একজন নিহত ও ছয়জন আহত হয়। প্রায় চারশো বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি অনুষ্ঠানে এ ধরনের হামলা সবাইকে বিস্মিত করেছে। রংপুর ও দিনাজপুরের বিভিন্ন চার্চের অন্তত ১২ জন ফাদারকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের বিশিষ্টজনদের প্রতিনিয়ত হুমকির বিষয়টিতো রয়েছেই। রয়েছে, বিদেশি হত্যা ও হুমকি এবং হত্যাচেষ্টার ঘটনা।
১০ নভেম্বর রাজধানী ঢাকার সেনানিবাসের কচুক্ষেত এলাকায় মিলিটারি চেকপোস্টে হামলায় এক মিলিটারি পুলিশ আহত হন। এর আগে দুটি চেকপোস্টে হামলার ঘটনায় নিহত হন দুই পুলিশ সদস্য। ২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে হামলায় একজন নিহত ও তিনজন আহত হন। নামাজ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে এ হামলা হয়। বেশ কয়েকবার হামলার ঘটনা হয়েছে দিনাজপুরে। কান্তজির মন্দিরে ৪ ডিসেম্বর রাসমেলার প্যান্ডেলে হাত বোমা মারা হয়। কাহারোলে ইসকন মন্দিরে ধর্মসভা চলাকালে হামলা চালানো হয়। সেখানে এর আগে একটি উপজেলার ইসকন সভাপতির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। সবশেষ ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর একটি মসজিদে গ্রেনেড হামলা হয়। প্রথম রাকাত শুরু হওয়ার পরপরই এ হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় নৌ-বাহিনীর দুজন ব্যাটম্যানকে আটকের কথা জানতে পেরেছি। জানি, এসব এলাকার নিরাপত্তা অত্যন্ত কঠোর। যদিও সেখানে সাধারণ মানুষও নামাজ পড়ত। অনেক ঘটনার মধ্যে বেশ কয়েকটি উদাহরণ দিলাম এ কারণে যে, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে যখন এসব ঘটনা ঘটত আমরা হয়তো হাসতাম। নিজেদের উদার দেশ বলে গর্ব ছিল, বলতেও ভালোবাসতাম। কিন্তু এখন সত্যি সত্যি আতঙ্ক এসে ভর করে। যদিও বিএনপি সরকারের সময় শায়খ আবদুর রহমান বা বাংলা ভাইয়ের অত্যাচার, ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা হামলা বা সিরিজ বোমা হামলার মতো আতঙ্ক নেই, গাড়িতে ‘কালো ব্যাগ’ নিয়ে কাউকে উঠতে দেখলে ভয় লাগে না। কিন্তু এরপরও মনে হয় আমাদের এখনই শক্ত হওয়ার সময় এসেছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর এক অনুষ্ঠান ও ২০ ডিসেম্বর বিজিবির দরবার হলে জঙ্গি দমনে এই দুই বাহিনীকেও সজাগ থাকার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে পুরাতন যাঁরা সশস্ত্র বাহিনীতে রয়েছেন তাঁদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া, নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বা চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় কিন্তু রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার বড় বড় কর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। কাজেই সর্ষের মধ্যে ভূত ঢুকে গেলে সে ভূত ছাড়ানো মুশকিল হয়ে পড়বে। জুতা চোরের মতো জঙ্গিরা যদি মসজিদ-মন্দির বা অন্য কোথাও ঢুকে পড়ে আত্মঘাতী হামলা চালায় সেটা ঠেকানো দায় হয়ে পড়বে বৈকি!
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, সময় টেলিভিশন