অর্থনীতি
রিজার্ভে চুরি, গভর্নরের পদত্যাগ, অতঃপর
ড. আতিউর রহমানের মেয়াদ ২০০৯ থেকে ২০১৬। অর্জন বলতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬ বিলিয়ন থেকে ২৮ বিলিয়নে নেওয়া। অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরির ঘটনাতেই পদ ছাড়তে হলো ড. আতিউরকে। যে রিজার্ভ নিয়ে শেষ চার বছর ধরে গর্ব করতেন তিনি, সেই গর্বই নষ্ট হয়ে গেল তাঁরই দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে। এজন্য পদ হারাতে হয়েছে দুই ডেপুটি গভর্নর ও ব্যাংকিং সচিবকেও। চাকরি হারানোর ভয়ে আছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো অনেক কর্মকর্তা।
একটু গোড়ায় যেতে চাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যাবলী কী হবে তা বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ এ স্পষ্ট করা আছে। ৬ টি প্রধান কার্যাবলীর মধ্যে চতুর্থ টি হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা ও ব্যবস্থাপনা। অন্য কার্যাবলীর মধ্যে রয়েছে মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বৈদেশিক ব্যবসায় নীতি প্রণয়ন, মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে সরকারকে পরামর্শ প্রদান, নিরাপদ পেমেন্ট সিস্টেম ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিধি বিধান প্রণয়ন ও তদারকি করা।
এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান হিসেবে গভর্নর ব্যর্থ হয়েছেন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ পেমেন্ট সিস্টেম গড়তে। অর্থাৎ অর্ডারের প্রধান দুটি কার্যাবলী পরিপালনে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
এখন দেখা যাক, রিজার্ভ কীভাবে ব্যবস্থাপনা ও লেনদেন হয়। রিজার্ভের অর্থ ব্যবস্খাপনা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ এন্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ। রিজার্ভের অর্থ লেনদেন হয় ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ফ্রন্ট অফিস ও অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের ব্যাক অফিসের পাসওয়ার্ড নিশ্চিত হওয়ার পরই। একইভাবে সংঘটিত হয়েছে রিজার্ভের অর্থ লোপাটও।
রিজার্ভ চুরি হয় মূলত অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের ব্যাক অফিসের তিন কম্পিউটার হ্যাক করেই। এর তিন কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত ছিল সুইফট ও আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্রোস সেটেলমেন্ট সিস্টেম) নেটওয়ার্কযুক্ত। সুইফট হলো আর্ন্তজাতিক ভাবে নিরাপদ পেমেন্ট তথ্য/কোড সরবরাহের নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশ ব্যাংকে যখন সুইফট নেটওয়ার্ক থাকা কম্পিউটারগুলোতে আরটিজিএস যুক্ত করে ঠিক তখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইটি বিভাগ এর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন রাতকেই হ্যাকডের জন্য নিরাপদ বেছে নেয় দৃর্বত্তরা শুক্রবার সকালে হ্যাকিংয়ের ঘটনা বুঝতে পেরেও চেপে যাওয়া হয়। পরে গভর্নরকে জানানো হলে ব্যাংকটির ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পরামর্শেই সরকারকে অবহিত করা থেকে বিরত থাকেন গভর্নর। এ নিয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকেই গোপনে তদন্ত শুরু হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি গোপনে দুই কর্মকর্তাতে ফিলিপাইন পাঠানো হয়। তাঁরা ফিলিপাইনের মানি লন্ডারিং বিভাগকে অবহিত করেন। তাঁরা তদন্তের জন্য আদালতের অনুমতি নিতে যাওয়ার পরই খবরটি সে দেশের সংবাদ মাধ্যমে চলে আসে। তবে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের খবর ৭ মার্চ সমকাল, বণিক বার্তা ও নিউ এইজ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকড হয়েছে। এর পরই বেকায়দায় পড়ে সেদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থমন্ত্রণালয়কে বিষয়টি লিখিতভাবে জানায়। এরপরের খবর তো সবারই জানা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বলেছে, রিজার্ভ খোয়া গেছে ৫ ফেব্রুয়ারি। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ ও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসলাম আলমের একাধিক বৈঠক হলেও তা মন্ত্রণালয়কে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড মিটিং হয়েছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ অডিট কমিটির বৈঠক হয়েছে সেখানে এটি এজেন্ডাভুক্ত করেনি। এসবই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য।
দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের চুক্তিভিত্তিক মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বদরুল হক খান। এর আগে তিনি বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। বেসরকারি খাতের একজন কর্মকর্তাকে হঠাৎ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের মহাব্যবস্থাপক করায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় এ বিভাগের সংশ্লিষ্টতার পরও বহাল তবিয়তে রয়েছেন সবাই। বিভাগে দায়িত্বেও কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। যারা রিজার্ভ লেনদেন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তারাও আছেন বহাল তবিয়তে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রিজার্ভ থেকে ৯৫১ মিলিয়ন ডলার চুরির চেষ্টা হয়েছিল। এরমধ্যে ৮৫০ মিলিয়ন ডলার ঠেকানো গেছে। বাকি ১০১ মিলিয়ন ডলার প্রসেসড হয়ে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল। তারমধ্য থেকে শ্রীলঙ্কায় পাচার করা ২০ মিলিয়ন ডলার ঠেকানো গেছে, যার ১৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার ফেরত এসেছে। আর ফিলিপাইনের এন্টি মানিলন্ডারিং টিম আছে তারা সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টগুলো ফ্রিজ করেছে। ফিলিপাইন থেকে ৬৮ হাজার ডলার ফেরত পাওয়া গেছে।
কয়েক বছর ধরে ড. আতিউর আইটি খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ব্যাংকগুলোতে তা অনুসরণ করতে বলেছেন। আইটি উন্নয়ন করে নিরাপদ পেমেন্ট সিস্টেম গড়ে তোলা কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্ডারের মধ্যেই ছিল। ফলে তাঁকে পদ ছেড়ে দিতে হয়েছে।
কিন্তু কয়েক বছরে তাঁর মেয়াদকালে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার যে লুটপাট ব্যাংক খাতে হয়েছে, এজন্য তাঁকে কেন আফসোসও করতে দেখা যায়নি, এটাই আজ বড় প্রশ্ন। দেখা যাচ্ছে, বিদায়ী গভর্নরের আশপাশে একটা বলয় তৈরি হয়েছিল। তারা প্রকৃত তথ্য তাঁর কাছে পৌঁছতেই দেয়নি। ফলে তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতে পারেননি। রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্রেও তাঁর কাছে যথাসময়ে প্রকৃত তথ্য আড়াল করা হয়েছে। এর দায় শুধু দুএকজনের নয়, তার আশপাশের সবারই। দেখা যাক নতুন গভর্নর কী ব্যবস্থা নেন। এরপরও নিশ্চয়ই আড়ালেই থেকে যাবে আরো নানা সত্য।
স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক বণিক বার্তা