ব্রেক্সিট
কেন বিচ্ছেদের পক্ষে ব্রিটিশরা?
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জোটবদ্ধ রাজনীতির ওপরে এক চপেটাঘাত বলা যায় একে। ১৯৯৩ সালের পয়লা নভেম্বর ইউরোপীয় দেশগুলোর যে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করেছিল ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার নিয়ে, আজ ২৩ বছর পরে এসে প্রথমবার ভাঙনের সম্মুখীন তারা। আর এই সিদ্ধান্ত এসেছে ইউরোপের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ ব্রিটেনের কাছ থেকে।
ব্রিটিশরা এক হয়ে সিদ্ধান্ত দিল তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়ে থাকতে চায় না। যদিও দেশটির সব রাজনীতিকরা এই সিদ্ধান্তে ধাতস্থ হতে পারছে না। আর তাই ফলাফল ঘোষণার পর পরই পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।
হাউজ অব কমন্সে যতগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে তাদের মধ্যে মাত্র দুটি দল তাও আবার সব মিলিয়ে সাতজন এমপি নিয়ে দাবি তুলেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার। এ ব্যাপারে কখনোই ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভরা তাদের মতামত খোলাসা করে প্রকাশ করেনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষেই বেশির ভাগ রাজনীতিবিদের মত ছিল। তবে সাধারণ ব্রিটিশরা শীর্ষ রাজনীতিবিদদের মতামত উপেক্ষা করেছে। শুধু তাই নয় রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ, ব্যবসায়ী ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের পরামর্শও তারা অগ্রাহ্য করেছে এবং রায় দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সরে যেতে চায় তারা।
ভোটের আগের গত কয়েক সপ্তাহ ছিল অস্থিরতা ও উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। দ্য ডেইলি মিররের মতে এই গণভোট, ‘স্মরণযোগ্য সবচেয়ে জঘন্য, বিভেদ সৃষ্টিকারী ও অপ্রীতিকর রাজনৈতিক কর্মসূচি।’
গণভোটের ফলাফলে দেখা গেল গভীরভাবে বিভক্ত এক জাতিকে। লন্ডন এবং স্কটল্যান্ড ভোট দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। এগুলো ব্রিটেনের বৃহৎ ও শিল্পোন্নত শহর। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ছোট শিল্পভিত্তিক শহর, গ্রাম, বাজারভিত্তিক শহর বা উপশহরগুলো সম্মিলিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে। তারা ব্রাসেলসের কাছ থেকে কর্তৃত্ব ফিরিয়ে নিতে চায়।
এখানে একটা প্রজন্মগত বিভেদের রেখাও স্পষ্ট। অপেক্ষাকৃত তরুণ, বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও গ্র্যাজুয়েটরা ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে ছিল। কিন্তু বয়স্করা প্রায় সবাই ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে।
রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো বারবার তারা অর্থনৈতিক মন্দার প্রসঙ্গ তুলে এনেছে, একে অতিরঞ্জিতভাবে প্রচার করেছে। সন্ত্রাসী আক্রমণের আশঙ্কা ও রপ্তানি বাজার হারানোর প্রসঙ্গও তারা এনেছে। বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব কমে যাওয়ার বিষয়টিও তারা জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। এই একই যুক্তি দেখিয়ে ব্রিটেন থেকে স্কটল্যান্ডের বিচ্ছেদ থামিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ রাজনীতিকরা।
কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে অনেক ভোটারের কাছেই এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তারা যেটা অনুভব করেছে সেটা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিচ্ছিন্ন, দাম্ভিক ও অকারণ একটি আঞ্চলিক জোট। আদতে এর কোনো সুফল ব্রিটিশরা পাচ্ছে না। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু সিদ্ধান্তে ক্ষিপ্ত ছিল। যেমন : শ্রমিকদের মুক্ত স্থানান্তর নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জোরাজুরি। এর ফলে ইউনিয়নের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলো থেকে ব্রিটেনে যে অভিবাসন ঘটছে সেটা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো অধিকার ব্রিটেনের থাকেনি। তাই ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর হাজার হাজার মানুষ কাজের সন্ধানে ব্রিটেনে আসতে শুরু করল এবং তারা সরকারি সেবার ওপর বাড়তি চাপ ফেলল। ব্রিটেনে ন্যূনতম মজুরির পরিমাণও কমতে থাকল।
ইউরোপের অন্য দেশগুলো থেকে অভিবাসনের এই মাত্রাতিরিক্ত ও নিয়ন্ত্রণহীন চাপই একমাত্র কারণ হতে পারে যার কারণে ব্রিটিশরা ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিল। এই চাপের কারণে অনেক ব্রিটিশকেই অর্থনৈতিক দীনতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সরকারের কঠোর মিতব্যয়ী নীতির কারণে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই ব্রিটিশরাই যারা একসময় অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ছিল অথচ এখন তাদের জীবনমান নিম্ন থেকে নিম্নতর হচ্ছে।
এ নিয়ে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের কোন দুশ্চিন্তা ছিল না। তিনি নিশ্চিত ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নেই থাকবে ব্রিটেন। যেভাবে তিনি স্কটল্যান্ডকেও রাখতে পেরেছিলেন ব্রিটেনের সঙ্গে। তবে একদিক থেকে ক্যামেরনের আশঙ্কা সত্যিই হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার খবরে পাউন্ডের দরপতন হয়েছে এবং সেটা যেকোনো সময়ের চেয়েই অনেক বেশি।
তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে এখন ব্রিটেন অনেক বেশি নিজের দিকে নজর দিতে পারবে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের দরিদ্র ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু অভিবাসীদের ভার আর ব্রিটেনকে বইতে হবে না। তবে তার মানে এই নয় যে ব্রেক্সিট সমর্থকরা বর্ণবাদী। কারণ দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত অনেকেই ব্রেক্সিট সমর্থক।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ব্রিটেনের আরো অন্তত দুই বছরের মতো সময় লাগবে। এর বেশিও লাগতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা জানিয়েছেন, তাঁরা ব্রিটেনের এই প্রস্থানকে কোনোভাবেই সহযোগিতা করবেন না। তবে ব্রিটেনকে প্রমাণ করতে হবে তাদের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ও সময়োচিত ছিল। নয়তো এরপর হয়তো ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে যেতে পারে স্কটল্যান্ডও। এই দাবিতে অনেকদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছে স্কটিশরা।
লেখক : সাংবাদিক