চরমপন্থা
কাশ্মীর থেকে বাংলাদেশ
দেশে দেশে চরমপন্থার ব্যবহার নতুন নয়। বিভিন্ন আদর্শের মানুষই চরমপন্থা ব্যবহার করে আসছে নানা সময়ে। চরমপন্থা সব সময় সহিংস হয়, তেমনটিও নয়। আমরণ অনশনের মতো অহিংস আন্দোলনের কর্মসূচিও এক ধরনের চরমপন্থা। মহাত্মা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই এমন পন্থা অবলম্বন করেছেন। তাঁরা সফলও হয়েছেন। তবে সাধারণত চরমপন্থা সংঘাতপ্রবণ সশস্ত্র হয়ে থাকে। অনস্বীকার্যভাবে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বে ১৯৭১-এ বাঙালি জাতিও চরমপন্থা গ্রহণ করেছিল, যা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। তবে সেই চরমপন্থার দুটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল—১. তা ছিল শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করার অব্যবহিত ফলাফল, ২. সেখানে ছিল জনমতের পূর্ণ প্রতিফলন।
ইদানীংকালে বহুল উচ্চারিত ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দের সঙ্গে চরমপন্থার সম্পর্কটি এখানে নির্দিষ্ট করা দরকার। স্পষ্টত জঙ্গিবাদও একটি চরমপন্থা। তবে সব চরমপন্থা জঙ্গিবাদ নয়। উর্দু ও ফার্সি জঙ্গ শব্দ থেকে জঙ্গি শব্দটির উৎপত্তি। এর মানে হলো যোদ্ধা। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী চরমপন্থার প্রতিশব্দ হিসেবে জঙ্গিবাদ শব্দটি প্রচলিত হয়েছে। গত ১ জুলাই ঘটে যাওয়া গুলশান হামলা এবং পবিত্র ঈদের দিন শোলাকিয়ায় হামলার পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গিবাদ ইস্যুটি বাংলাদেশে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল। আক্রমণের ধরন, প্রকৃতি এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি এ প্রাসঙ্গিকতায় নতুন একটি মাত্রাও দিয়েছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির সামনে এটা নতুন এক চ্যালেঞ্জও হাজির করেছে। সেই প্রেক্ষিতেই এই লেখা। কাজেই বাংলাদেশই এর মূল আলোচ্য। তবুও প্রসঙ্গের যৌক্তিকতা বিবেচনায় কাশ্মীরের গত কয়েক দিনের ঘটনাবলির একটি বিশ্লেষণ এখানে হাজির করা জরুরি।
এ কথা সবারই জানা, কাশ্মীর একটি অমীমাংসিত বিভাজিত এলাকা। এর মালিকানা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের একাধিক যুদ্ধ ও নিরবচ্ছিন্ন দ্বন্দ্বও কারও অজানা নয়। পাশাপাশি কাশ্মীরের ভারতশাসিত অংশে ১৯৯০ সাল থেকে কয়েকটি সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। স্বাধীনতার দাবি কাশ্মীরিদের নতুন নয়। ১৯৪৭ সালেও তৎকালীন হিন্দু মহারাজা ভারতে যোগদানের আগে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন একটি স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে থাকতে। পাকিস্তান বা ভারত কোনো দিকেই তিনি যেতে আগ্রহী ছিলেন না। এ জন্য তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে স্ট্যান্ডস্টিল চুক্তিও স্বাক্ষর করেছিলেন। নানা ঘটনাপ্রবাহের শেষে তিনি ভারতেই যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার দাবিতে কাশ্মীরিদের অস্ত্র তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৭ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পরই। সেখান থেকেই কাশ্মীরে চরমপন্থার শুরু। বিভিন্ন আদর্শের একাধিক চরমপন্থী গ্রুপ সেখানে সক্রিয় ছিল দশকব্যাপী। সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গির জাতীয়তাবাদী জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট (জেকেএলএফ) ও ইসলামী ভাবধারার হিজবুল মুজাহিদিন ছিল দুটি প্রধান গ্রুপ, যারা ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র চরমপন্থা গ্রহণ করেছিল। এ ছাড়া পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়েবাও ছিল কাশ্মীরে সক্রিয়। এই সব গ্রুপই পাকিস্তান থেকে অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ পেত। কাশ্মীরি যুবকদের জন্য তখন চরমপন্থা হয়ে উঠেছিল একরকম ফ্যাশন।
তবে ৯/১১-এর পর থেকেই পাকিস্তানের প্রকাশ্য সহায়তা সীমিত হতে থাকে। জেকেএলএফ নেতারা আত্মসমর্পণ করে চারমপন্থার ইতি টানে। জামায়াতে ইসলামীর মতো ইসলামী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। ক্রমান্বয়ে যুবকদের অংশগ্রহণ কমতে থাকে। কিন্তু সেটি বন্ধ হয়নি। শূন্যে নামিয়ে আনতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এখনো বিভিন্ন সরকারি রিপোর্ট অনুসারে অন্তত দুই-তিনশ যুবক জঙ্গি তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছে ভারতশাসিত কাশ্মীরের বিভিন্ন পাহাড়ি জঙ্গলে। সংগঠন হিসেবে মূলত হিজবুল মুজাহিদিন ও লস্কর-ই-তৈয়েবার নাম শোনা যায়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, চরমপন্থায় মানুষের অংশগ্রহণ কমলেও তার প্রতি সমর্থন কমেনি; বরং বেড়েছে। ‘হাম কেয়া চাহতেহে?/আজাদি’ এ স্লোগান এখনো কাশ্মীরের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লোগান। গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ এরই বাস্তব প্রমাণ। ২২ বছর বয়সী বুরহান ওয়ানি নামের যে হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার গত শনিবার (৯ জুলাই) নিহত হয়েছে, তার সমর্থনে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়ই মিছিল হতো, ‘বুরহান ভাই আগে বাড়ো, হাম সব তোমহারি সাথ হ্যায়’। স্কলারস হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই স্লোগান শুনে উপলব্ধির চেষ্টা করতাম, চরমপন্থার প্রতি এত জনসমর্থনের হেতু কী? বুরহান কাশ্মীরের চরমপন্থায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। দক্ষিণ কাশ্মীরের ত্রাল এলাকার জঙ্গলে বসে কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গোর সঙ্গে সশস্ত্র ছবি তুলে সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিত। আর তা ছড়িয়ে পড়ত ভাইরাসের মতো ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে।
বুরহান হয়ে উঠল কাশ্মীরি যুবকদের কাছে এক ‘মহান’ হিরো। তার জানাজায় হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়েছে। এর আগে এক জঙ্গির মৃত্যুর পর তার লাশ নিয়ে কয়েকটি গ্রামের লোকদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগেছিল। প্রত্যেক গ্রামের লোকেরা তাদের গ্রামে লাশ দাফনের বিরল সৌভাগ্যের (!) অধিকারী হতে চেয়েছিল। বুরহানের মৃত্যুর প্রতিবাদে মিছিলে যোগ দিয়ে অন্তত এক কুড়ি সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হলো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে। এ থেকে বোঝা যায়, কতটা জনপ্রিয় এই চরমপন্থা। প্রসঙ্গত, এই চরমপন্থার বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—১. তীব্র জনপ্রিয়তা, ২. তারা স্বাধীনতার দাবি কিংবা অন্তত ভারতীয় বাহিনীর প্রতি ঐতিহাসিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করছে। পাশাপাশি তৃতীয় আরেকটি বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখ করা জরুরি। তা হলো, কাশ্মীরি এই চরমপন্থা ইসলামী-জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত। অনেকে এই তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে কাশ্মীরি চরমপন্থাকে ইসলামের নামে চলমান আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে থাকেন, যা কাশ্মীরের ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে বেমানান।
ফিরে আসি বাংলাদেশে। কাশ্মীরি চরমপন্থার দীর্ঘ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার মূল উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে তার বৈপরীত্য তুলে ধরা। বাংলাদেশে এখন কিছু বিভ্রান্ত যুবক, যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত, ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে চরমপন্থার সঙ্গে যুক্ত। প্রায় সব বিশ্লেষণে আসছে যে, তারা দেশি হলেও তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সংযোগ আছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক আ ন ম মুনীরুজ্জামান গত বছরই ‘সাইবার র্যাডিক্যালাইজেশনের’ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে তরুণরা চরমপন্থার দিকে ঝুঁকছে এবং যুক্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে। তারা এমন চক্রে জড়িয়ে যাচ্ছে বুঝে কিংবা না বুঝে। এখানে সবচেয়ে বড় আশার দিক হলো, এরা জনবিচ্ছিন্ন।
গণমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে, জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে নিহত হওয়া পথভ্রষ্ট যুবকের হতভাগ্য বাবাও তার ওই সন্তানের লাশ গ্রহণ করতে আগ্রহী নন। একজন বাবা তাঁর সন্তানের অপরাধের জন্য বিশ্বের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এটাই বর্তমান জঙ্গিবাদী চরমপন্থা মোকাবিলায় বাংলাদেশের মূল শক্তি। এই বাস্তবতা থেকে সুস্পষ্ট যে, জনসমর্থনহীন চরমপন্থা কিছুতেই স্থায়ী হতে পারে না, সফল তো নয়ই। এ ক্ষেত্রে আশঙ্কার বিষয় হলো, আজকের জনবিচ্ছিন্ন চরমপন্থা যেকোনো মুহূর্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। যখন নরম-স্বভাবিক পন্থা কাজ করে না, তখনই মানুষ চরমপন্থার সমর্থন করে। মানুষের ক্ষোভ-প্রতিবাদগুলো যখন নরম ভাষায় প্রকাশিত হয়, তখনই তা আমলে নেওয়া দরকার। অন্যথায় তারা ক্রমে বেছে নেবে চরম পথ। ক্রমে তা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। তাই রাজনৈতিক শূন্যতার অবসান অপরিহার্য।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক।