তুরস্ক সংকট
সেনাবাহিনীর নড়াচড়ায় কঠিন পরীক্ষায় এরদোয়ান
সেনাশাসনের ইতিহাস তুরস্কে নতুন নয়। দেশটিতে সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল ১৯ বছর আগে ১৯৯৭ সালে। এর আগে ১৯৭১-সহ আরো বেশ কয়েকবার অভ্যুত্থান হয়। তবে দেশটিতে গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তিত হওয়ার পর জনগণ ভেবেই নিয়েছিল সেনা হস্তক্ষেপের দিন শেষ। ধারণা ভুল হলো। সেনাবাহিনীর বিপথগামী একদল সেনার হাতে আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হলো গণতন্ত্র। গত বছরের পয়লা নভেম্বরে এক নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম এবার কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি! প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠলেও শঙ্কা কিন্তু থেকেই যায়। তুরস্ক কি তাহলে মিসরের পথে হাঁটল? সেনাশাসনের অধীনে থাকা মিসরে ইসলামপন্থী মুরসি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে ক্ষমতা হারায়। মুরসির মিত্র বলে পরিচিত ইসলামপন্থী এরদোয়ান কি ঠিক একই পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন? সে প্রশ্নই এখন ঘুরছে। হঠাৎ এ ধরনের নড়াচড়া সেনাবাহিনীর মধ্যে ঐক্য নষ্ট তো হবেই; সঙ্গে গণতন্ত্রের স্বাদ পাওয়া জনগণ হারাতে বসবে বিশ্বাস। তাতে সামগ্রিকভাবে ক্ষতি হবে। পাশাপাশি ঘোষণা অনুযায়ী কঠোর হাতে এদের নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ হলে এরদোগান সরকারকে বেশ বিপাকে পড়তে হবে।
সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ঘোষণার দিন না ঘুরতেই নিয়ন্ত্রণ এলেও; ৯০ জনকে দিতে হলো প্রাণ। সব মিলিয়ে বিপথগামী সেনাসহ ১৫০০ জনকে আটক করেছে তুরস্ক পুলিশ। সরকারের দাবি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ এসেছে। সেনাবাহিনীর বিপথগামীদের হাতে জিম্মি হতে যাওয়া দেশও এখন মুক্ত। এ অবস্থার পেছনে সরকারের ভূমিকার চেয়ে প্রশংসার দাবি রাখে দেশের সাধারণ মানুষের ভূমিকা। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের চেষ্টা রুখতে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত সাড়া দেয় দেশের জনগণ। মূলত সরকার সমর্থিত নেতাকর্মীদের দেখা যায় সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। রাতেই রাজধানী আংকারাসহ ইতিহাস বিখ্যাত ইস্তাম্বুল শহরের রাস্তার বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে নারী-পুরুষ সবাইকে। আকাশ ও রাজপথে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধের মুখে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান শনিবার প্রথম প্রহরে ইস্তানবুলে পৌঁছে বিমানবন্দরে এক ভাষণে বলেন, অভ্যুত্থানচেষ্টাকারীরা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে। এ সময় জনগণ তাঁকে স্বাগত জানায়। ঐতিহাসিক তাকসিন স্কয়ারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেশের জনগণের এ প্রতিরোধের সঙ্গে বিশ্বনেতারাও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের পাশে দাঁড়ান। বারাক ওবামা ও জাতিসংঘের মহাসচিব তাঁদের পৃথক বার্তায় জনগণকে নির্বাচিত সরকারের পাশে থেকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। এর আগে বিভিন্ন মসজিদ থেকে ফজরের নামাজের আগে আজান দেওয়া হয় এবং মানুষকে ‘গণতন্ত্র রক্ষার’ জন্য রাস্তায় নামার আহ্বান জানানো হয়। ন্যাটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তুরস্কেও গণতান্ত্রিক এ সংকটে নতুন করে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান।
রাজপথে অভ্যুত্থানকারীদের কর্তৃত্ব হারানোর প্রকাশ ঘটলেও তাদের পক্ষ থেকে এক ই-মেইলবার্তায় বলা হয়েছে, লড়াই চালিয়ে যাবেন তাঁরা। তবে এরদোয়ানকে দেশের ভেতর-বাইরে থেকে একচেটিয়া সমর্থন দেওয়ায় এ লড়াই শেষ কোথায় গিয়ে থামে তা এখন দেখার বিষয়। অবশ্য তুরস্ক সরকারের পক্ষ থেকে এখনো স্পষ্ট করে বলা হয়নি কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তবে ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনের অনুসারী সৈন্যরা এই অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনাকে অনভিপ্রেত উল্লেখ করে অভ্যুত্থানকারীদের চরম মূল্য দিতে হবে বলে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন এরদোয়ান। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথাও বলেছেন তিনি।
মধ্য অর্থনীতির এ দেশটিতে এ ধরনের অভ্যুত্থানচেষ্টা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশ প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ইউরেশিয়ার এ দেশ কদিন আগেই বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার মুখে পড়ে। রক্তের সে দাগ এখনো না শুকাতেই আবারও আঘাত! এ ধরনের সেনা-অভ্যুত্থান চেষ্টা দেশের মানুষকে যেমন নতুন করে ভাবাবে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ডানপন্থী এরদোয়ান সরকারকেও গভীরভাবে ভাবতে হবে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। বিশেষ করে তুরস্কেও আজকের এ অবস্থানের পর একটি ঘটনা বারবার আলোচনায় আসবে। সেটা নিশ্চয় মিসরের মুরসির পতন। একই রাজনৈতিক ধারা এবং খানিকটা একই প্রেক্ষাপটের দেশ হিসেবে এ সমীকরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন এরদোগান। তিনি নিশ্চিত চাইবেন না সামরিক কোনো সরকারের হাতে আটকে থেকে বিচারের মুখোমুখি হতে। গণতন্ত্রকে আগলে রাখার দায়িত্ব এখন তাঁকেই নিতে হবে। তবে কাজটি করতে হবে বেশ সাবধানে। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে কঠোর ধর্মীয় নিয়ম পালনসহ যেসব অভিযোগ আছে সেগুলোও বিবেচনায় আনতে হবে। আর এটাকেও হিসাব করতে হবে বিশ্বনেতারা আজ সেনা সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে অসুবিধায় পড়বেন বলেই হয়তো গণতন্ত্রের কথা বলে এরদোয়ানকেই ক্ষমতায় রাখতে চাচ্ছে। কিন্তু দেশের ভেতরের কোনো গোষ্ঠী যদি বিপথগামী সেনাদের সঙ্গে হাত রেখে এরদোগান সরকারের হটানোর চেষ্টা করে তাহলে সেটা রুখতে পারবে তো এ সরকার? এ প্রশ্নের পাশাপাশি আরো যে প্রশ্নটি না করলে নয়। হটাৎ করে এরদোয়ানকে রাজধানীর বাইরে রেখে এ অভ্যুত্থানচেষ্টা কি আসলেই বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে? যে কোনো কারণ ছাড়াই নাড়া দিয়ে বসল সেনাবাহিনী? ঘটনার আগেও তো এ ধরনের কোনো আভাস মেলেনি। সব মিলিয়ে এবার সরকার গঠনের মাত্র আট-নয় মাসের মাথায় এ ধরনের অভ্যুত্থান চেষ্টা পুরো শাসনকালের ওপরও একধরনের প্রভার রাখবে। এরদোয়ানকে প্রতিটি মুহূর্তে ভাবতে হবে এদের নিয়ে। আর যাই হোক, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও চিন্তা করতে হবে, আসলেই এরদোয়ান সরকার কতটুকু নিরাপদ? আবার কেউ ক্ষমতা কেড়ে নিতে এলো কি না? এসব ছাপিয়ে এ অভ্যুত্থান চেষ্টায় যে বিষয়টি বেশি সাধুবাদ পাবে। তা দেশের জনগণের প্রতিরোধ। জনগণ রাতের আঁধারে, নারী-পুরুষ সবাই মিলে যেভাবে রাস্তায় নেমে এসে রক্ত দিল; তাতে গণতন্ত্র রক্ষায় দেশপ্রেমের এক উদাহরণ হয়ে থাকবে তুরস্কের সংকটের এ ঘটনাটি।
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।