ফ্রান্সে হামলা
মানুষের আসল শত্রুটা কে?
‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার অর্থনীতির প্রভু হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ত্রিশের দশকের মহামন্দা কাটিয়ে ওঠে; সারা দুনিয়ায় অস্ত্র ও সেনার যে চাহিদা সৃষ্টি হয়, তা সরবরাহ করে দেশটির অর্থনীতি উঠে দাঁড়ায়। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪-এর মধ্যে দেশটির প্রকৃত উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৬৫ শতাংশ, শিল্প উৎপাদন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে ৯৫ শতাংশ [যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের অবস্থা অনেকটাই ভঙ্গুর]। যুদ্ধের পরপরই ইউরোপ ও জাপানের উৎপাদনব্যবস্থা ধসে পড়ায় এ সময় দুনিয়ার মোট উৎপাদনের ৬০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে হয়।’ (প্রতিচিন্তা, জানুয়ারি-মার্চ ২০১৫; সম্পাদনা : মতিউর রহমান; পৃ ৩৮)
বস্তুতপক্ষে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্ব যে যুদ্ধ অর্থনীতির যুগে প্রবেশ করে, তা বর্তমানেও অব্যাহত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে কোনো সময় যে কোনো দেশের ওপর হামলা চালাতে পারে এই জুজুর ভয় দেখিয়ে, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ রেখে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অস্ত্র-সেনা ব্যবসা অব্যাহত এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে অস্ত্র-সেনা-তেল লুটপাট-ব্যবসার মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকটের ফল ‘জঙ্গি’। বর্তমান বিশ্বে চলছে এই জঙ্গি হামলা ও জঙ্গি-অর্থনীতির জয়জয়কার। বিভিন্ন গণমাধ্যমের দাবি, গত বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের নিস শহরে বাস্তিল দিবসের অনুষ্ঠানে ট্রাকচাপা দিয়ে ৮৪ জনকে হত্যাও একটি বর্বরোচিত জঙ্গি হামলা। কথা হলো, বর্তমানে এই যুদ্ধ অর্থনীতির যুগের সারথী শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, যোগ হয়েছে আরো নতুন নতুন রাষ্ট্র।
২.
মধ্যপ্রাচের ‘জঙ্গি’গোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে আধিপত্যবাদীদের মধ্যে অন্যতম ইসলামিক স্টেট বা আইএস। এই আইএসের কার্যক্রম শুধু আর মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এশিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোতেও তারা বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে আসছে। তবে এখন গুরুতর প্রশ্ন হলো, এতদিন না হয় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো মধ্যপ্রাচ্যসহ আফ্রিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে হামলা চালিয়েছে। সম্প্রতি আইএস পশ্চিমের দেশগুলোর ওপর হঠাৎ করে হামলা শুরু করল কেন? এই বিষয়টা পরিষ্কার হতে আগে জানা দরকার, এই আইএস কারা?
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ডের মতে, সাদ্দামের পতনের পর ক্ষমতাসীন বা পার্টিকে নিষিদ্ধ করলে তাৎক্ষণিক চাকরি হারান ইরাকি সেনাবাহিনীর প্রায় চার লাখ সদস্য। সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কারের পর সাদ্দামের অনেক সমর্থক আইএসে যোগ দিয়ে বেশ বড় বড় পদ পান। তারাই মূলত আইএসের পেশাদার বাহিনী গঠনে বড় ভূমিকা পালন করছেন। ব্রিটেনের লেবার পার্টির সদস্য বব ক্যাম্পবেলের অভিযোগ, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছে। (আইএস নিয়ে উল্টো খবর!, হারুন উর রশীদ; ‘বাংলা ট্রিবিউন’, ১৩ জুলাই ২০১৬)
এখন প্রশ্ন, ইউরোপ-আমেরিকার এত দেশ থাকতে ফ্রান্সেই কেন বিরতি দিয়ে দিয়ে তিনবার (নিস শহরে হামলার আগেও আইএস ফ্রান্সে দুটি ভয়াবহ হামলা চালায়) হামলা হলো? এর উত্তরও মেলে বব ক্যাম্পবেলের এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে ‘ফ্রান্স ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরই আইএস ফ্রান্সে দুবার সন্ত্রাসী হামলা চালায়; জাপান ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরই দুই জাপানি অপহৃত হয় ও আইএস তাদের হত্যা করে; ইন্দোনেশিয়া ফিলিস্তিনের গাজায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার পরই আইএস জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম এই মুসলিম রাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালায়; ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বেলজিয়াম একটি বৈঠকের আয়োজন করার পরই আইএস ইউরোপের এই দেশটিতে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। আরো কত সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার ঘটার পর বিশ্ব বুঝতে পারবে যে ইসরায়েলই আইএসকে চালাচ্ছে?’ (আইএস নিয়ে উল্টো খবর!, হারুন উর রশীদ; ‘বাংলা ট্রিবিউন’, ১৩ জুলাই ২০১৬)
তবে আশঙ্কার কথা হলো, পশ্চিম এসবের মধ্য দিয়ে আবার যুদ্ধ অর্থনীতির অংশ হয়ে উঠছে। কারণ ফ্রান্সসহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ সন্ত্রাসী হামলার শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ এগুলো শেষ না, বরং শুরু মাত্র। বিচ্ছিন্নভাবে কিছুই ঘটে না, সবকিছুরই একটা ধারাবাহিকতা থাকে। সব ধারাবাহিকতায়ই থাকে শুরু-মধ্য-অন্ত। ফ্রান্সসহ ইউরোপের অল্পবিস্তর এই সন্ত্রাসী হামলাগুলো যদি শুরু হয়ে থাকে, তাহলে এর মধ্য-অন্তের ভয়াবহতা নিশ্চয় সহজেই অনুমেয়।
৩.
বাংলাদেশে ব্লগারদের হত্যা শুরু হলে তখন এ দেশের অনেকেই এই বলে প্রশান্তির ঢেঁকুর তুলেছেন, ‘নাস্তিক’দেরই তো হত্যা করছে, আমাদের তো আর না। কিন্তু এই ভুল ভাঙতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ধীরে ধীরে তা শিক্ষক, লেখক, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, দেশি-বিদেশি, দরজি সব শ্রেণির মানুষ আক্রান্ত হতে শুরু করে। এখন চাপাতির কোপ থেকে জিম্মি করে গলা কাটা-গুলি করে হত্যা, বোমা হামলায় রূপ নিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্ষেত্র এখন অনেকটাই প্রস্তুত। এখন হয়তো আসবে ‘ত্রাতারা’ দেশবাসীকে উদ্ধার করতে। সে জন্যই হয়তো কিছুদিন পরপর এখানে ঘটবে হলি আর্টিজান বেকারি, শোলাকিয়ার মতো নারকীয় সব ঘটনা।
ঠিক একইভাবে পশ্চিমাদের অনেকেই হয়তো ভেবেছেন, মধ্যপ্রাচ্য-আফ্রিকার মতো পিছিয়ে পড়া, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, গোড়া-ধর্মান্ধ, বর্বর দেশগুলোতে তো সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে। তাদের তো কিছু হচ্ছে না। বরং তাদের মতো ‘ত্রাতা’ দেশগুলো ‘সাহায্যে’র হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই ভুলও হয়তো এখন অনেকের ভাঙতে শুরু করবে, কারণ শুধু মধ্যপ্রাচ্য-আফ্রিকা নয়, তারাও যে কোনো সময় হামলার শিকার হতে পারে, হচ্ছে। বস্তুতপক্ষে, যে স্বার্থান্বেষী মহল এসবের জন্য দায়ী, তাদের কোনো দেশ-জাতি নেই। তারা শুধু সম্পদ বৃদ্ধির লোভে এহেন নিকৃষ্ট কাজে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। তবে নির্মমতা হলো, তারাও যে কোনো সময় এর শিকার হতে পারে। কারণ এই সম্পদ বা পুঁজির মালিক অল্পকিছু ব্যক্তি বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। যে কোনো সময় ওই সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সম্পদ বা পুঁজি স্থানান্তর হয়ে যেতে পারে। তখন ওই ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু এই সম্পদ বা পুঁজি ঠিকই অন্য জায়গায় বা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের হাতে গিয়ে তার সম্পদ বৃদ্ধি করবে, আর তা করতে গিয়ে ঘটাবে নানা ধরনের সহিংস ঘটনা।
৪.
আলোচনা শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয় দিয়ে। কিন্তু যদি প্রশ্ন ওঠে, ওই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধা কি সব মার্কিনিরা সমানভাবে ভোগ করেছে? এর উত্তরে হয়তো বলতে হবে, নিশ্চয় না। এর সুবিধার প্রায় পুরোটাই ভোগ করেছে অস্ত্র-ব্যবসায়ী কোম্পানি ও তৎকালীন সরকার। ঠিক একইভাবে জঙ্গিবাদী যুদ্ধ অর্থনীতির যে মুনাফা তাও ভোগ করছে অস্ত্র-তেল লুটপাট-ব্যবসায়ী কোম্পানি এবং এসব বহুজাতিক কোম্পানির সহযোগিতায় গঠিত সংশ্লিষ্ট সরকার।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছিল, বর্তমানে এই যুদ্ধ অর্থনীতির যুগের সারথী শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, যোগ হয়েছে আরো নতুন নতুন রাষ্ট্র। সম্প্রতি প্রকাশিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্দেশে করা কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চ (সিএআর)-এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অন্তত ২০টি দেশ আইএসকে অস্ত্র সরবরাহ করে। এর মধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও রয়েছে, যাদের সাতটি কোম্পানি আইএসকে অস্ত্র সরবরাহ করে। এ ছাড়া এই তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল, রুমানিয়া, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, হল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের নাম।
এ থেকে খুব সহজেই অনুমেয় যে, আইএসকে অস্ত্র সরবরাহ করার পেছনে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে। তা না হলে ওই রাষ্ট্রগুলো নিশ্চয় অস্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত, কিন্তু তা দেখা যায় না। এর কারণ হয়তো সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র ও কোম্পানিগুলো একে অপরের পরিপূরক।
৫.
বর্তমানে সারা বিশ্বেই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এতে আর কিছু নয়, মরছে শুধু মানুষ। কেউ অস্ত্রের সহিংসতায় মরছে, কেউ সম্পদের স্বল্পতায় সৃষ্ট নানা সহিংসতায়, আবার কেউ পরিবেশ বিপর্যয়ের, কিংবা অন্য কোনো উপায়ে। তাই হয়তো এখনই চিহ্নিত বলতে হবে, এই পৃথিবীর, পৃথিবীর মানুষের প্রকৃত শত্রু কে?
স্পষ্ট ভাষায় বললে হয়তো বলতে হবে, বহুজাতিক কোম্পানি আর তাদের মদদপুষ্ট রাষ্ট্র। কিন্তু এসব কোম্পানিগুলোর ভেতরের কথা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উঠে আসে না। কারণ যে কোম্পানির অস্ত্রের ব্যবসা, সেই কোম্পানিরই গণমাধ্যমের ব্যবসা, তেলের-গ্যাসের-খনিজ সম্পদের ব্যবসা। অর্থাৎ সুই থেকে বিমান বানানো সবই কোম্পানিগুলো নির্মাণ করে থাকে। তাই এরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে, রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হাতেই জিম্মি বিশ্বের মোট সম্পদের বেশির ভাগটাই। আর সেই সম্পদকে আরো দ্বিগুণ করতে রাষ্ট্রের সহযোগিতায় তারা প্রতিনিয়ত চালায় সহিংসতা, নানা ছলে-বলে-কৌশলে।
ফলে এখন আর কোনো হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম আমেরিকান ইহুদি কিংবা ‘জঙ্গি’দের নয়, প্রতিরোধ করতে হবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সম্পদকে দ্বিগুণ করার সহিংস-প্রক্রিয়া। না হলে বিশ্বব্যাপী এই সহিংসতা কমবার নয়। তাই এখন হয়তো সবাইকে অন্তত স্পষ্ট ভাষায় বলতে হবে, নিস শহরে হামলাসহ এই পৃথিবীর হন্তারক বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের মদদপুষ্ট রাষ্ট্র।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।