বিশ্ব সাদাছড়ি দিবস
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের করুণা নয়
প্রতিদিনই কোনো না কোনো দিবস রয়েছেই। তবে সব দিবসেরই কিছু কিছু গুরুত্ব অবশ্যই রয়েছে। আবার দিবস ও বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনায় একই দিনে একাধিক দিবসও পালিত হতে দেখা যায়। কারণ একবার বছর ঘুরে এলে মাত্র দিনের সংখ্যা হলো ৩৬৫। কিন্তু দিবস যে আরো বেশি। তা ছাড়া প্রতিবছরই আবার নতুন নতুন গুরুত্বপূর্ণ আরো দিবস যুক্ত হচ্ছে এসব দিবসের বহরে। যেমন ১৫ অক্টোবরের কথাই ধরা যাক। এদিন বিশ্ব সাদাছড়ি দিবসের পাশাপাশি আরো কমপক্ষে দুটি দিবসের অস্তিত্ব লক্ষ করা যাচ্ছে। তার একটি হলো ‘আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস’ এবং আরেকটি হলো ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস’।
বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনায় এর সবগুলোই অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ গ্রামীণ কৃষিসহ অন্যান্য গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতির ওপর সচেতনতা সৃষ্টির জন্য অবশ্যই আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবসটি পালনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অপরদিকে নোংরা ও অপরিষ্কার হাতের জীবাণু ধ্বংস করার জন্য বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস পালনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টিরও প্রয়োজন রয়েছে। আর সে জন্যই একই দিনে একাধিক এসব দিবস পালন করা হচ্ছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিশ্ব নিরাপদ সাদাছড়ি দিবস পালনের বিষয়টি। কারণ আমরা সবাই জানি এবং সব একবাক্যে স্বীকার করব যে, বিশ্বে যত রকমের শারীরিক প্রতিবন্ধিতা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো মানুষের অন্ধত্ব। কারণ যার চোখের দৃষ্টি নেই, চোখের আলো নেই তার বিশ্বে কোনো কিছুই নেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, এসব সচেতনতার মাধ্যমেই আজ বিশ্বের মানুষ এ দৃষ্টিহীনতাকে জয় করতে সমর্থ হচ্ছে। আমরা আমেরিকার এক সফল অন্ধ মহীয়সী সমাজসেবী, রাজনীতিক ও শিক্ষক নারী হেলেন কেলারের কথা নিশ্চয়ই শুনে থাকব।
হেলেন কেলার ১৮৮০ সালে ২৭ জুন আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই বিশ্বে প্রথম অন্ধ নারী, যিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন। তারপর তিনি তার শিক্ষাকে সমাজের সেই সব অন্ধ ব্যক্তির কল্যাণে কাজে লাগিয়েছিলেন। সেই মহীয়সী নারী তাঁর আহরিত জ্ঞানের আলো সারা বিশ্বে বিলিয়ে দিয়ে ১৯৬৮ সালের ১ জুন মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁরই হাত ধরে আজকের বিশ্বে অন্ধদের জন্য কল্যাণকর অনেক কিছু করা হয়েছে। কোনো একজন অন্ধ ব্যক্তির জন্য একটি সাদাছড়ি অর্থাৎ দিক নির্দেশক একটি লাঠিই দিতে পারে তাকে জীবনের পথ চলার দিশা দেখাতে। কীভাবে একজন মানুষ দৃষ্টিহীনতার শিকার হন? কেউ থাকে জন্মান্ধ আবার কেউ জন্মের পর বিভিন্ন রোগের কারণে স্থায়ী দৃষ্টিহীনতায় রূপান্তরিত হন। তার মধ্যে চোখের ছানি রোগের সঠিক চিকিৎসা না হওয়া ও সময়মতো সচেতনভাবে অপারেশন না করার জন্য স্থায়ী দৃষ্টিহীনতার শিকার হয় অনেক মানুষ বলে মনে করে চিকিৎসাবিজ্ঞান।
প্রায়ই বিভিন্ন দাতব্য চিকিৎসালয় থেকে চোখের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করতে দেখা যায়। তাতে অনেক কাজ হয় দরিদ্র রোগীদের জন্য। কাজেই এর সুফল ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তার ব্যাপ্তি আরো বাড়ানো যেতে পারে। এখন বাংলাদেশে স্থায়ী দৃষ্টিহীনলোকের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে দৃষ্টিহীন লোকের এ সংখ্যা নেহাত কম নয়। অথচ একটু সচেতন হলেই ভয়াবহ এ রোগ থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। ফিরে পেতে পারে মহা মূল্যবান চোখের দৃষ্টি। অন্ধত্ব নিয়েও আজকে অনেক লোক কারোর করুণায় নয়, বরং তাদের নিজস্ব যোগ্যতায় বিশেষ পদ্ধতিতে স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে জীবন গঠনের জন্য চাকরি করে নিজের এবং পরিবারের হাল ধরছে। সরকারি ও বেসরকারি অনেক চাকরিতেও কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে তাদের জন্য। আজকের বিশ্ব সাদাছড়ি দিবসের দিনে তাই সেসব দৃষ্টিহীন ব্যক্তির নিরাপদে চলাফেরা করার জন্য একজন সচেতন কর্মক্ষম মানুষ হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
এ দিবসটি সর্বপ্রথম ১৫ অক্টোবর হিসেবে পালনের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে ১৯৬৪ সালে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই থেকেই তা প্রতিবছরের ১৫ অক্টোবর পালিত হয়ে আসছে। এ দিনের অঙ্গীকার হোক এ রকম যে, আমরা অন্ধদের করুণা না করে তাদের সহযোগিতা করব। কারণ তারা কারো করুণা চায় না, চায় সবার সহযোগিতা। আবার প্রকৃত অন্ধই শুধু অন্ধ নয়। সমাজে দেশে অনেক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন মানুষ রয়েছেন, যাঁরা চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে বসে থাকেন। আজকের এ দিনে তাঁদের চোখেও আলোকময় সুদৃষ্টি আনয়ন করতে হবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়