আবুল কাসেম ফজলুল হকের স্মৃতিচারণ
দীপনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/10/31/photo-1477891874.jpg)
দীপনের মৃত্যুর পর আজ এক বছর পূর্ণ হলো। আমার আর দীপনের মায়ের এই দিনগুলো কীভাবে যে কেটেছে, তা ভাষায় বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। দীপনের মা প্রতিদিন কেঁদেছে। একটু শান্ত হয়েছে, আবার কেঁদেছে। দীপনের বহু বন্ধু দেশে-বিদেশে অবস্থানরত, তাঁরা কেঁদেছে। টেলিফোনে কথা বলতে গিয়েও তাঁরা কেঁদেছে । দীপন যে কতজনের প্রিয় ছিল, একান্ত ঘনিষ্ঠ ছিল, তা আগে বুঝিনি। দীপন সামান্য মানুষ হয়েও অসামান্য ছিল। আমি অস্থির কম হই। আমার কষ্ট সহ্য করার শক্তি হয়তো একটু বেশি। লোকজনের সামনে অবিচল থাকার চেষ্টা করেছি। আমার স্বভাব অনুযায়ী চিন্তা করেছি, কথা বলছি। দিন-রাতে যখনই একলা থেকেছি, চোখ কেবল অশ্রুসিক্ত হয়েছে।
পরিচিত-অপরিচিত, বিখ্যাত, অখ্যাত, ক্ষমতাবান, ক্ষমতাহীন, দেশি-বিদেশি, নারী-পুরুষ, প্রবীণ ও নবীন, বহুজন আমাদের সঙ্গে দেখা করে সান্ত্বনা দিতে এসেছেন। অনেকে পত্রপত্রিকায়, ফেসবুকে অনলাইনে দীপনকে নিয়ে লিখেছেন। দীপনের বন্ধুরা এসেছে। নিজেকে নিঃসঙ্গ জানতাম। কিন্তু এত বিরাট সংখ্যক লোকের ভালোবাসায় ও সহানুভূতিতে সিক্ত হয়ে নিঃসঙ্গতাবোধ আমার কেটে গেছে, যাঁরা ছুটে এসেছেন এবং যাঁরা দূরে থেকে যোগাযোগ করছেন, তাঁদের আপন মনে হয়েছে। মানুষের দুঃখে যাঁরা সহানুভূতি জানাতে আসেন, সাহায্যের হাত প্রসারিত করেন, তাঁরা মহৎ। দীপনের অকালমৃত্যুর পর যাঁরা আমাদের কাছে ছুটে এসেছেন, তাঁদের মহত্তের স্পর্শ আমরা অন্তরে অনুভব করেছি। তাঁদের প্রতি আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ।
আমি হিংসা-প্রতিহিংসায় বিশ্বায় করি না। সমাজে অন্যায়ের শাসন রক্ষা করার জন্য বিচার ও অপরাধীর শাস্তি দরকার; কিন্তু যে বিচার ও শাস্তির দায় সমাজে প্রতিহিংসা তৈরি হয়, তাকে আমার কাছে ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়। বাংলাদেশে আজকাল বিচার যেভাবে হচ্ছে, তা প্রতিহিংসা তৈরি করছে। নৈতিক চেতনার উন্নতি না হলে অবস্থা স্বাভাবিক হবে না। নৈতিক চেতনার জাগরণ না ঘটলে, শুভবোধের উত্থান না ঘটলে অনাচার ও অধর্ম দমবে না। গণতন্ত্রের ধারা উন্নত হবে না, উন্নত নেতা দেখা দেবে না, সুশাসন ও সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টি হবে না। যারা হত্যাকারী, গুপ্তহত্যা করে চলছে, তারা তো মানুষের কাতারে নেই। কথায় বলে ‘পাপে বাপেরেও ছাড়ে না’।
গুপ্তঘাতকরা শাস্তি পাচ্ছে, পাবে। আমরা অবশিষ্ট মানুষরা কি শুভবুদ্ধি ধারায় পরিচালিত হচ্ছি? গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতীয়তাবাদ, বিশ্বায়ন ইত্যাদি নিয়ে কী চলছে আজ দুনিয়ায়? আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা, আত্মশুদ্ধি, আত্মোৎসর্গ দরকার। এসব নিরন্তন সাধনার ব্যাপার, জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে সাধনার ও সংগ্রামের ব্যাপার। ব্যক্তির কিংবা সমষ্টির চিত্ত শুদ্ধি, চিত্ত উৎকর্ষ রাতারাতি হয়ে যায় না। বাংলাদেশের ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে কেন? বাংলাদেশ আধুনিক যুগ থেকে মধ্যযুগের দিকে যাত্রা করছে কেন? সমাজের স্তরে স্তরে মানুষের মনের দিকটায় দৃষ্টি দিতে হবে।
সম্পদের পাহাড়-পর্বত তৈরি হচ্ছে, কিন্তু মানবীয় গুণাবলির দিকে দিয়ে মানুষ পশুর পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ‘জাগৃতি প্রকাশনী’ ও ‘জাগৃতি’ কথাটা গ্রহণ করা হয়েছে ‘রেনেসাঁস’ অর্থে। আগেকার রেনেসাঁস ছিল মধ্যযুগের গর্ভ থেকে আধুনিক যুগকে মুক্ত করা, মধ্যযুগের প্রাপ্তি, অনাচার ও নির্যাতন থেকে মুক্তির ও নতুন সৃষ্টির তাগিদে সামনে এগিয়ে চলা। আজকের নতুন রেনেসাঁসের লক্ষ্য হচ্ছে আধুনিক যুগের বিভ্রান্তি, দুর্গতি থেকে মুক্তির নতুন সৃষ্টির লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে চলা নতুন রেনেসাঁসের চেতনা ও কর্মতৎপরতার অভাবে ইতিহাসের সম্মুখগতি বজায় থাকেনি। কায়েমি স্বার্থবাদীরা মানবজাতিকে নিয়ে চলছে পেছনের দিকে। আমাদের সামনে চলতে হবে। পক্ষপাতমুক্ত, দৃষ্টিতে সব দিকে তাকিয়ে প্রকৃত অপশক্তিকে চিনতে হবে। শুভশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে নতুন রেনেসাঁস ও নতুন গণজাগরণকে সম্ভব ও সফল করতে হবে। ‘জাগৃতি’ মানে ‘রেনেসাঁস’। দীপন মানে আলো জ্বালানো, আলোকিত করা। দীপন নেই, মহৎ মানবীয় গুণাবলি নিয়ে জাগ্রত হওয়ার, আলোকিত হওয়ার এবং আলোকিত করার সাধনা ও সংগ্রাম আমাদের অবলম্বন হতে পারে।
লেখক : সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।