মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়
মানুষের জন্য যা কল্যাণকর, তাহাই ধর্ম। যে ধর্ম পালন করতে গিয়া মানুষের অকল্যাণ করিতে হয়, তাহা ধর্মের কুসংস্কার মাত্র। মানুষের জন্য ধর্ম। ধর্মের জন্য মানুষ নয়। কথাগুলো বলেছিলেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ। এই বাক্যগুলোর মর্মার্থ বিবেচনায় না গিয়ে গত ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে যা ঘটে গেল, তা নিয়ে কিছু বলতে চাই। ঘটনার ফলাফল, হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক ঘরবাড়ি ও প্রায় ১৫টি মন্দির ভাঙচুর। সঙ্গে চলেছে লুটপাটও।
আমি বরাবরই নিজেকে হিন্দুর চেয়ে মানুষ হিসেবে ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তাই একজন মানুষ হিসেবেও ঘটনাটি আমাকে নাড়া দেয়। যে সমাজে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা, চলাফেরা, কাজকর্ম, উদযাপন সবকিছুতেই সবার অংশগ্রহণ। সহপাঠী, প্রতিবেশী থেকে শুরু করে সহকর্মী পর্যন্ত আলাদা ধর্মের কিংবা বর্ণের হলেও যেন একই সৌহার্দ্যের বন্ধনে আবদ্ধ। সেই সমাজে শুধু ফেসবুকের একটা পোস্ট কেন্দ্র করে এ ধরনের তাণ্ডব, মেনে নেওয়া যায় কি? কোনো এক গ্রামে একজন অপরাধী বাস করে বলে কি পুরো গ্রাম ভাঙচুর করতে হবে? পুরো গ্রামে লুটপাট চালাতে হবে? তাহলে নাসিরনগরে যারা হামলা চালাল, লুটপাট করল, তারা কি এর মাধ্যমে ধর্ম রক্ষা করল? এটা কি অপরাধ নয়? হ্যাঁ, অপরাধ। আর এ ধরনের অপরাধে যারা ইন্ধন দেয়, তারাও অপরাধী।
ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে, তার কি তথ্যপ্রযুক্তি আইনে বিচার সম্ভব ছিল না? তাহলে তাকে বিচারের মুখোমুখি না করে কেন অন্যদের ওপর হামলা চালাতে হবে? সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, হামলার সময় প্রতিবেশীদের কেউ তাদের রক্ষায় আসেনি। হায়রে মানুষ, হায়রে মানবতা! যে প্রতিবেশীদের সঙ্গে প্রতিদিনের চলাফেরা, সে প্রতিবেশীও এমন অন্যায়কে সমর্থন দিল কেবল ধর্মের ভিন্নতার জন্য।
আমি যখন জন্ম নিই, অন্য আরেকটা শিশুর মতো আমি মানুষই থাকি। তার পর নাম দেওয়ার পর থেকে হয়ে যাই হিন্দু বা মুসলিম। আর তখন মানুষ পরিচয়টা হারিয়ে যায় ধর্মের আড়ালে। এ সমাজে এটা যেমন চরম সত্য, তার বৈপরীত্যে হলো ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ একই সঙ্গে উদযাপন করে উৎসব। জাতীয় বিজয়ে একই সঙ্গে করে উল্লাস। সেখানে থাকে না ধর্ম-বর্ণ, এটাও সত্য। কিন্তু পরের সত্যটির কথা সবাই ভুলে যায়। মানুষ, মানবতা, মনুষ্যত্ব সবকিছু হারিয়ে যায় ধর্ম রক্ষার নামে তথাকথিত অপকর্মের মাধ্যমে।
কেবল নাসিরনগর নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। হিন্দুদের মন্দির ছাড়াও কখনো বৌদ্ধমন্দির, কখনো চার্চে চলে হামলা। এ ছাড়া এসব সংখ্যালঘুর বাড়িঘরে হামলা, ধর্ষণ, খুন, গুমের ঘটনাও ঘটছে হরহামেশা। কেবল ধর্মীয় অনুভূতির ধোয়া তুলে অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে যায়। এসব ঘটনায় রাষ্ট্রও কেন জানি বিমাতাসুলভ আচরণ প্রদর্শন করে। অনেক সময় রাষ্ট্রের এমন আচরণে ইন্ধন পায় অপরাধীরা। কিছু কিছু ঘটনায় তো সরাসরি উসকানি দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়।
অসাম্প্রদায়িক দেশের কথা বলি আর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় যদি চুপ থাকি, বিচার না হয়, তাহলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ কী করে সম্ভব? নাকি কেবল বলার জন্যই বলা। বিচার না হলে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আরো বাড়বে, যার ফলাফল কেবল সংখ্যালঘু নয়, হয়তো কারো-ই জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
পরিশেষে আবারও বলতে চাই—মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়।
লেখক : জয়ন্ত কর্মকার, বার্তাকক্ষ সম্পাদক, নাগরিক টেলিভিশন