দৃষ্টিপাত
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ
ঢাকা শহরের বুকে আমাদের একটা ছোট পাঠাগার আছে, নাম ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার’। জাতীয় দিবসগুলোতে আমরা এই বাচ্চাদের জন্য নানা আয়োজন রাখি। ওদের নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহিদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, কবি নজরুলের সমাধি, জগন্নাথ হলের গণকবর, অপরাজেয় বাংলা, চারুকলা ইনস্টিটিউট, একুশের বইমেলা, বাংলা একাডেমি এসব বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে নিয়ে যাই। আর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এলে থাকে বাড়তি আয়োজন।
গত বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পাঠাগারের বাচ্চাদের নিয়ে আমরা গেলাম মিরপুরে। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। দেশের মন্ত্রী-আমলারা আসছেন, সরকারি-বিরোধী দলের নেতারা আসছেন। হইচই হচ্ছে। জয়ধ্বনি আর জিন্দাবাদে চারদিক মুখরিত করে তারা ফুল দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
এরই এক ফাঁকে আমাদের ফুল দেওয়ার পালা এলো। বেদির সামনে গিয়ে দেখি ভয়াবহ কাণ্ড! কে কার আগে ফুল দেবে— এ নিয়ে হুড়াহুড়ি, হইচই, ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলি। ফুল দেওয়ার আগে যা হচ্ছে তা তো হচ্ছেই, কিন্তু ফুল দেওয়ার পর যা হচ্ছে তা না দেখলেই ভালো ছিল। ছাত্রজীবনেও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গিয়েছি। ফুল দিয়েছি। তখন নানা কারণেই হয়তো এ দৃশ্য চোখে পড়েনি। এবার এমন দৃশ্য দেখতে হলো যা দেখতে চাইনি, বিশেষত সঙ্গের ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে।
একদিকে ফুল রাখা হচ্ছে, আর মুহূর্তের মধ্যেই সে ফুলের ডালি লুট হয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চারা এসে ফুলের ডালাগুলো টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ এক-আধবার বাচ্চাগুলোকে ধমক দিচ্ছে, ওই পর্যন্তই। ফুল লুটের মহোৎসব চলছে বিরামহীনভাবে। আমাদের দেওয়া ফুলের ডালিটাও আমরা থাকতে থাকতেই উধাও হয়ে গেল।
আমরা ফুল দিয়ে নেমে এলাম। কিন্তু আমাদের সঙ্গে থাকা ছোট ছেলেমেয়েগুলোর তখন অনেক কৌতূহল। ‘ওরা কেন ফুল নিয়ে যাচ্ছে? পুলিশ কেন ওদের বাধা দিচ্ছে না? ওরা এই ফুল নিয়ে কী করবে?’ ওদের কৌতূহল মেটাতে আমরা গেলাম স্মৃতিসৌধের পেছনের দিকে। ওখানকার দৃশ্য আরো ভয়াবহ। ফুল নিয়ে চলছে কাড়াকাড়ি, মারামারি, গালাগালি। যে বাচ্চাগুলো ফুল লুট করছে ওদের গায়ে নোংরা জামা-কাপড়, ময়লা শরীর। অনর্গল গালি নিঃসৃত হচ্ছে কারো কারো মুখ থেকে। ওদের সঙ্গে বেশ কিছু বয়স্ক নারী-পুরুষও যোগ দিয়েছে।
আমাদের এক ছোট সদস্য, যে সচ্ছল পরিবারের সন্তান, সে এসব দেখে ওদের উদ্দেশ্যে গালি দিল— ‘বস্তি’। আমাদের সঙ্গে যে ছেলেমেয়েরা ছিল ওদের কেউ কেউ সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, কেউ দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। দরিদ্র পরিবারগুলো বস্তিতেই থাকে। তাই আমাদের একজন সদস্য যখন ‘বস্তি’ বলে কাউকে গালি দেয়, তখন সেটা বস্তিবাসী সদস্যদের গায়ে গিয়েও লাগে। এ বিরোধ-বিসম্বাদও নিরসন করতে হয়।
ফুল লুটকারী কজন বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, ওরা আশপাশের বস্তি এলাকায় থাকে। ফুলগুলো তারা বাসায় নিয়ে যাবে। সেগুলো থেকে ভালো ফুল বাছাই করে মালা গাঁথবে, ফুলের তোড়া বা মালা বানিয়ে বিক্রি করবে। অক্ষত ফুলের তোড়া বা ডালা পেলে লাভ বেশি, ভালো দাম পাওয়া যায়। অনেক বাচ্চার সঙ্গে তাদের পরিবারের বড় সদস্যরাও এসেছে। শহীদ বেদির পেছনে ফাঁকা জায়গায় তারা বসে আছে। বাচ্চারা ফুল লুট করে আনছে, তাদের কাছে জমা রাখছে। এক মহিলাকে দেখলাম, লাকড়ি জমা করছে ফুলের ডালা ভেঙে।
ওই বাচ্চাদের ও তাদের পরিবারের বড় সদস্যদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা জানে কি না এখানে কেন লোকে ফুল দিচ্ছে? এখানে কাদের কবর? তারা জানে না। এখানে তারা পেটের ধান্দায় শুধু ফুল চুরি করতে আসে। আর তাই ১৪ ডিসেম্বর মানেই তাদের কাছে কিছু বাড়তি আয়-রোজগারের দিন, আনন্দের একটা দিন। অবাক হবেন না পাঠক, এটাই সত্যিকার বাংলাদেশের একটা অংশ। জীবন্ত অংশ।
এই মাটিতে শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, সেলিনা পারভীনসহ আরো অনেক বুদ্ধিজীবীর মৃতদেহ শায়িত আছে। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন স্বাধীন একটা বাংলাদেশ, যেখানে শোষণ-নির্যাতন থাকবে না, অশিক্ষা, চিকিৎসাহীনতা থাকবে না। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে তাদের সেই স্বপ্নের কতটুকু বাস্তবায়ন আমরা দেখছি? তাদেরই কবরের পাশে আমাদের দেশের শিশুরা ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে ছুটে আসে, মারামারি করে বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে অর্পণ করা ফুল লুট করতে। এটা তো দেশে বিদ্যমান বৈষম্য আর বঞ্চনার খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। বৈষম্য আর বঞ্চনার আসল চিত্র আরো ভয়াবহ, আরো বিরাট।
অনেক দিন আগে শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার লিখেছিলেন, ‘বেচারা ক্ষুদিরাম, বেচারা আশফাকউল্লাহ, বেচারা সূর্য সেন, স্বাধীনতার জন্য তোমরা ফাঁসিতে ঝুলি ছিলে। কোনো রকমে পরপার থেকে একবার এদেশে বেড়াতে এসে স্বাধীন দেশের এই চেহারা দেখলে তোমরা কী করতে? আত্মাহুতির বদলে আত্মহত্যা করতে?’
২০১৬ সালের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এবং বিজয় দিবসের লগ্নে, উন্নয়নের মহাসড়কে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকা বাংলাদেশ দেখলে শহীদুল্লাহ কায়সার বা মুনীর চৌধুরী কী করতেন? প্রশ্নটা আমাকে খুব ভাবায়।
লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার