ফিরে দেখা ২০২২ : ক্রিকেটে বাংলাদেশের অম্ল-মধুর বছর
‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে / হারা শশীর হারা হাসি, অন্ধকারেই ফিরে আসে।’ কবির ছন্দে কণ্ঠ মিলিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটও যেন বছরের শুরুতে আড়াল থেকেই হেসে ওঠে। সে হাসির রেখা বছর জুড়ে ভক্তদের আনন্দে ভাসিয়েছে। আবার খানিক মেঘের অন্ধকারে মলিনও হয়েছে আশার সঞ্চিত বাসনা। সবমিলিয়ে ২০২২ সালে অম্ল-মধুর বছর কাটিয়েছে বাংলাদেশ।
বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে জয়, আর শেষে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ। মাঝে আশা-হতাশার ঝোড়ো বাতাস দুলিয়েছে ভক্তদের। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ৩২ ম্যাচের ১৭টিতে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। তাতে ২০২২ সাল যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ভালো কিছুর পূর্বাভাস নিয়ে আসে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই বছরটি কেমন কাটল দেখে নেওয়া যাক—
সাফল্য যথারীতি ওয়ানডে ক্রিকেটে
বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে পছন্দের ফরম্যাট এটি। সেজন্য বেশিরভাগ জয় এসেছে এই ফরমেট থেকেই। ২০২২ সালে ১৫টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ১০টিতেই জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এর মধ্যে পাঁচটি সিরিজের চারটিতে জয়। হার শুধু জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে। জয় এসেছে আফগানিস্তান (২-১), দক্ষিণ আফ্রিকা (২-১), ওয়েস্ট ইন্ডিজ (৩-০) এবং বছরের শেষদিকে ভারতের (২-১) বিপক্ষে।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পুরোনো তিক্ততা
এই ফরম্যাটে বছরটা আগের মতোই তিক্ততা ছড়িয়েছে। ব্যাটে-বলে হতাশা দেখিয়েছেন ক্রিকেটাররা। পুরো বছরে চারটি সিরিজ, এশিয়া কাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ মিলিয়ে মোট ১৭ ম্যাচে মাত্র ৬টি জয় এসেছে বাংলাদেশের। ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত এই ফরম্যাটটির সঙ্গে যেন বাংলাদেশের তিক্ততা আগে থেকেই। বারবার নাস্তানাবুদ অবস্থা হয়েছে। বছরের শুরুর দিকে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১-১ সিরিজ সমতা এবং তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষ সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ২-০ তে সিরিজ জয় বাদে তেমন রেকর্ড নেই বাংলাদেশের।
যদিও অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ২ ম্যাচ জিতে রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। তবে বিপক্ষ দল হিসেবে ছিল নেদারল্যান্ডস ও জিম্বাবুয়ে। কোনো শক্ত প্রতিপক্ষের বিপক্ষে জয় পায়নি বাংলাদেশ। আর এশিয়া কাপে আসেনি কোনো জয়। আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়তে হয়েছে সাকিব আল হাসানদের। ওয়েস্ট ইন্ডিজ (০-২), জিম্বাবুয়ের (১-২) বিপক্ষে হারতে হয়েছে টি-টোয়েন্টি সিরিজ।
টেস্ট ক্রিকেটে ব্যর্থতার গান
সকালের সূর্য দেখলে বলে দেওয়া যায় দিনটি কেমন যাবে। তবে বাংলাদেশের টেস্ট ভাগ্যের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টোটা। বছরের শুরুতেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে জয় পেলেও সিরিজে আসে ১-১ সমতা। এছাড়া শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি ড্র বাদে সারা বছরে জয়সূচক গন্তব্য আর নিশ্চিত হয়নি। পাঁচ সিরিজের ১০ ম্যাচের ৮টিতেই রয়েছে হারের হতাশা। ফলে ২০২২ সালে ক্রিকেটের বড় পরিসরে তামিম-লিটনদের নেই কোনো সামগ্রিক রেকর্ড।
যেমন গেল আট দেশের বিপক্ষে বাংলাদেশের সিরিজ
বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ১-১ সমতা পায় বাংলাদেশ। ফেব্রুয়ারি-মার্চে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৩ ওয়ানডের ২-১ এ জয় এবং ২ টি-টোয়েন্টিতে আসে ১-১ সমতা। মার্চ-এপ্রিলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২টি টেস্ট ম্যাচে হার এবং ৩ ওয়ানডের ২-১ এ জয় পায় বাংলাদেশ। মে মাসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২ ম্যাচ টেস্ট সিরিজের একটি ড্র ও একটিতে হারে বাংলাদেশ।
জুন-জুলাইতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হার দেখে বাংলাদেশ। ৩ ম্যাচের টি-টোয়েন্টির একটি বৃষ্টির কারণে বাতিল হয় এবং বাকি দুটিতে জয় পায় উইন্ডিজরা। তবে ৩ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে তাঁদের হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ।
জুলাই-আগস্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩টি ওয়ানডে খেলে ২-১ এ জয় পায় বাংলাদেশ। তবে তিন টি-টোয়েন্টির ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হারে সোহান-সৈকতরা। সেপ্টেম্বরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ২-০ তে সিরিজ জেতে বাংলাদেশ।
বছরের শেষদিকে ভারতের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ২-১ এ জিতে নেয় বাংলাদেশ। তবে টেস্টে ২-০ তে হেরে যায় সাকিবের দল।
২০২২ সালের বিভিন্ন সিরিজে ব্যক্তিগত অর্জন
বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে জয় পায় বাংলাদেশ। ৭ উইকেট নিয়ে টেস্ট ম্যাচ জয়ের নায়ক হন ইবাদত হোসেন। দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশ হারলেও লিটন দাস করেন সেঞ্চুরি। ফেব্রুয়ারিতে আফগান্তিানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে লিটন দাস সেঞ্চুরি করে দলকে জেতান। ২৫ ফেব্রুয়ারির সে ম্যাচে লিটন করেন ১২৬ বলে ১৩৬ রান।
মে মাসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে তামিম ইকবাল এবং মুশফিকুর রহিম করেন সেঞ্চুরি। দুই সেঞ্চুরি ও লিটন দাসের ৮৮ রানের কল্যাণে সে ম্যাচে ড্র করে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় টেস্টটি বাংলাদেশ হারলেও মুশফিক ও লিটনের সেঞ্চুরি অন্য এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়। দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে লিটন করেন ১৪১ রান এবং মুশফিক করেন অপরাজিত ১৭৫ রান।
জুলাই মাসে বাংলাদেশ ওয়ানডেতে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। তৃতীয় ওয়ানডেতে তাইজুল ইসলাম ২৮ রানের বিনিময়ে তুলে নেন উইন্ডিজের ৫ উইকেট।
৩১ জুলাই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ২০ রান দিয়ে তুলে নেন ৫ উইকেট। ম্যাচটিতে জয় পায় বাংলাদেশ। সে ম্যাচে লিটন দাস করেন ৩৩ বলে ৫৬ রান।
ডিসম্বরে বাংলাদেশ সফরে আসে বাংলাদেশ। প্রথম ওয়ানডেতে মেহেদী হাসান মিরাজের নৈপুণ্যে জয় পায় লিটনরা। সে ম্যাচে সাকিব নেন ৫ উইকেট, এবাদত নেন ৪টি। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করেন মিরাজ। সঙ্গে পান ২ উইকেট।
তাতে পরপর দুই ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মিরাজ। যদিও শেষ ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ২২৭ রানের বড় ব্যবধানে হারে। তারপরেও মিরাজ-সাকিবদের এমন কৃতিত্ব ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’ বার্তা দেয়। এ দিকে ভারত সিরিজে দুটি টেস্টেই বাংলাদেশ হারে। তবে অভিষিক্ত জাকির হাসানের টেস্ট সেঞ্চুরি বাংলাদেশের শেষের আলো ফুটিয়েছে।
এশিয়া কাপে বাংলাদেশ
২০২২ সালের এশিয়া কাপে বাংলাদেশের ভালো সময় কাটেনি। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে এবং দ্বিতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে বাংলাদেশ। আর টি-টোয়েন্টিতে ভারত, পাকিস্তানের মতো পরাশক্তিকে হারিয়ে এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলঙ্কা।
অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অর্জন
১৬ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অষ্টম আসর। এই আসরে বাংলাদেশ সরাসরি মূলপর্বে খেলার টিকিট পায়। শুধু তাই নয় দীর্ঘ ১৫ বছর পরে ক্রিকেটের বৈশ্বিক এই সংস্করণে জয় পায় বাংলাদেশ।
যদিও প্রতিপক্ষ ছিল তুলনামূলক দুর্বল নেদারল্যান্ডস, তারপরও এতদিন পরের জয়ে উচ্ছ্বসিত হন ভক্তরা। ম্যাচটিতে অগ্নিঝরা বল করে ৪ উইকেট নেন পেসার তাসকিন আহিমেদ। শুধু এই ম্যাচেই নয় বাকি ম্যাচেও দারুণ বল করে বিশ্বের সামনে অন্য এক বাংলাদেশকে তুলে ধরেন তাসকিন।
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তাসকিন ৪ ওভার বল করে ২৫ রান দিয়ে তুলে নেন ৪ উইকেট। এর মধ্যে ডট বল আদায় করেন ১৬টি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৪ ওভারে ১৯ রান দিয়ে পান ৩ উইকেট। আর দুটিতেই হয়েছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ভারত আর পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনো উইকেট না পেলেও দুর্দান্ত বল করেন তাসকিন।
এ ছাড়া বিশ্বকাপের এই আসরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৭১ রান করেন নাজমুল হোসেন শান্ত। ভারতের বিপক্ষে লিটন করেন ৬০ রান, আর হাসান মাহমুদ পান ৩ উইকেট। যদিও পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যাটিং ব্যর্থতায় বাংলাদেশের আর রেকর্ড খাতায় নাম লেখানো হয়নি। সে ম্যাচে শান্তর ৫৪ রানের শান্ত ইনিংস শুধু সান্ত্বনাই দিয়েছে।
বছরের শেষদিকে কোচের পদত্যাগ
গত ২৭ ডিসেম্বর ই-মেইলের মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে পদত্যাগপত্র পাঠান প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু তার আগে তিনিই পদত্যাগপত্র পাঠান। ফলে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হবে নতুন কোচের হাতে নতুন মাত্রায়। এরকমই প্রত্যাশা দল, বিসিবি এবং ক্রিকেট ভক্ত বাঙালিদের।