ভেঙে দুই টুকরো জয়সালের টুর্নামেন্ট-সেরার ট্রফি
যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। তবে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ হলেও টুর্নামেন্ট-সেরার পুরস্কার ওঠে যশস্বী জয়সালের হাতে। সর্বোচ্চ রান নিয়ে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি।
তবে জয়সালের টুর্নামেন্ট-সেরার ট্রফিটি ভেঙে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে জয়সাল দেখেন, তাঁর ট্রফিটি ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেছে। যদিও ট্রফি নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই ভারতীয় ক্রিকেটের এই তরুণ তারকার।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কীভাবে ট্রফিটা ভেঙে গেল, তা জানেন না জয়সাল। জানার কোনো আগ্রহও নেই তাঁর। তরুণ এই ওপেনারের কোচ জ্বালা সিংহের দাবি, ট্রফি নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই জয়সালের। ভারতের এক দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জ্বালা সিংহ বলেছেন, ‘জয়সাল ট্রফি নিয়ে খুব বেশি ভাবনা-চিন্তা করে না। রান নিয়েই বেশি চিন্তা করে।’
যুব বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে ৪০০ রান করেছেন জয়সাল। সেমিফাইনালে ম্যাচ-জেতানো সেঞ্চুরিসহ আরো চারটি হাফ-সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। এ ছাড়া ফাইনাল ম্যাচেও দারুণ ছিলেন জয়সাল।
ফাইনালে যশস্বী একাই টানছিলেন ভারতীয় ইনিংসকে। খারাপ শট খেলে তিনি আউট হয়ে যাওয়ার পর ভারতও আর বড় রান করতে পারেনি।
সেই ইনিংস নিয়ে জয়সাল বলেন, ‘আমি খারাপ শট খেলে আউট হয়েছি। ওই সময়ে ওরকম শট খেলার দরকার ছিল না। বলটা একটু জোরেই এসেছিল। অতটা যে দ্রুত আসবে, তা আমি বুঝতে পারিনি। বিশ্বকাপ জিততে পারলে ভালোই লাগত। তবে না জেতায় পৃথিবী যে শেষ হয়ে গিয়েছে এমনটা নয়।’
এই জয়সালই একদিন ফুচকা বিক্রি করে জীবন চালাতেন। উত্তর প্রদেশের ভাদোহিতে জন্মগ্রহণ করেন জয়সাল। সেখানেই বেড়ে ওঠা। তবে শৈশব না কাটতেই ভাগ্য বদলাতে বাবার সঙ্গে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান জয়সাল। মুম্বাইতে হার্ডওয়্যারের দোকান দেন তাঁর বাবা। বাবার ছোট্ট দোকানে সাহায্য করতেন এই প্রতিভাবান ক্রিকেটার। চাচার বাসায় থাকতেন। কিন্তু কিছুদিন গেলে বাসা ছোট হওয়ায় সেখানেও ঠাঁই হলো না। পরে বাবা চলে গেলে সেই বাসা ছাড়তে হয় জয়সালকে।
তবে বাসা ছাড়লেও নতুন সন্ধান চাচাই দিয়েছিলেন জয়সালকে। কলকাতার আজাদ ময়দানের তথ্য চাচাই দেন তাঁকে। আজাদ ময়দানে তাঁবুর মধ্যে থাকতেন মাঠকর্মীরা। সেখানেই নিজের পরবর্তী ঠিকানা খুঁজে নেন জওয়াল। মাঠকর্মীদের সঙ্গে একই তাঁবুতে বছর তিনেক কেটেছে তাঁর। তাঁবুতে বিদ্যুৎ না থাকায় রাত কেটেছে খোলা আকাশের নিচেও।
তাঁবুতে খাবারের কষ্ট ছিল। বাবা গ্রামে ফিরে যাওয়ার পর খাবার জোগানো কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল জয়সালের। জীবিকার তাগিদে বেছে নেন পানিপুরি বিক্রির পথ। সঙ্গে চালিয়ে যান ক্রিকেট অনুশীলন।
জয়সালের ক্রিকেট গল্পের পেছনে অবশ্য আরেকজন ছিলেন। তিনি হলেন কোচিং গুরু জ্বালা সিং। ২০১৩ সালে আজাদ ময়দানে একদিন ‘এ’ ডিভিশনের বোলারদের বিপক্ষে ব্যাটিং করছিলেন জয়সাল। তখনই সিংয়ের নজরে আসেন তরুণ এই ক্রিকেটার। সিং শোনেন জয়সালের বেড়ে ওঠার গল্প। জয়সালের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব নেন তিনি।
তাঁবু থেকে জয়সালকে নিজের বাসায় নিয়ে আনেন। রোজ পাঠান ক্রিকেট মাঠে। গুরুর সঙ্গ পেয়ে নিজেকে মেলে ধরেন জয়সাল। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জ্বালা সিংয়ের অধীনে অনুশীলন করার কয়েকদিনেই জাইলস শিল্ডের এক ম্যাচে ব্যাট হাতে ৩১৯ এবং বোলিংয়ে ভালো করেন তিনি। এরপর আরেক ম্যাচে করেন ডাবল সেঞ্চুরি। সেই ব্যাটিংয়ের পরই হৈচৈ তাঁকে নিয়ে।
২০১৮ সালে যোগ দেন অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ দলে। বাংলাদেশে হওয়া সেই টুর্নামেন্টেও আলো ছড়ান। দুর্দান্ত করেন রঞ্জি ট্রফিতেও। তবে বেশি নজর কাড়েন বিজয় হাজারের ট্রফিতে। সেই টুর্নামেন্টে অভিষেক হয় লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে করেন ৪৪, পরের ম্যাচেই সেঞ্চুরিতে ১১৩ রানের ইনিংস। এরপর চতুর্থ ও পঞ্চম ম্যাচে করেন ১২২ ও ২০৩। নজরে চলে আসেন ক্রিকেট দুনিয়ার।
মাত্র ২০ লাখ ভিত্তিমূল্যতে আইপিএলের নিলামে নাম ওঠে জয়সালের। গত বছর নয় ডিসেম্বর হওয়া সেই নিলামে তাঁকে নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি হয়ে যায়। শুরুতে আগ্রহ দেখায় কলকাতা। এরপর যোগ দেয় মুম্বাই। প্রথম দাম ওঠে ৫০ লাখ রুপি। তৃতীয় দল হিসেবে লড়াইয়ে যোগ দেয় পাঞ্জাব। দাম ওঠে ৮০ লাখ। কলকাতা এবার ছুড়ে দেয় কোটির চ্যালেঞ্জ। রাজস্থানও যোগ দেয় কোটির লড়াইয়ে।
এক লাফে দাম ওঠে যায় দুই কোটিতে। তখন কলকাতা দুই কোটি ২০ লাখে দলে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আরো ২০ লাখ বাড়িয়ে দেয় রাজস্থান। শেষ পর্যন্ত দুই কোটি ৪০ লাখ দিয়ে রাজস্থান ভেড়ায় সেই ফুচকাওয়ালা জয়সালকে।
আজাদ মাঠের সেই পানি পুরি বিক্রেতা এখন আইপিএলের কোটিপতি ক্রিকেটার। পরিশ্রম আর ক্রিকেটের প্রতি প্রেমই জয়সাল বানিয়ে তুলেছে আজকের রাজস্থান তারকা বা ভারতীয় ক্রিকেটের তারকা।