লিওনেল মেসির আকাশি-সাদা দুঃখগাথা
নির্ধারিত ৯০ মিনিট ও অতিরিক্ত সময়ের খেলা গোলশূন্য ড্র হওয়ার পরেই হয়তো বুকটা কেঁপে উঠেছিল মেসির। আবারও কি ফিরে আসছে ২০১৫ সালের কোপা আমেরিকার স্মৃতি? সেবারও তো চিলির বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল আর্জেন্টিনার। বাড়তি একটা চাপই যেন ঘিরে ধরেছিল আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে। আর সেটারই প্রতিফলন যেন দেখা গেল পেনাল্টি শুটআউটের সময়।
প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের জটলার মধ্য থেকে দুর্দান্ত সব গোল করে যিনি প্রায়ই মুগ্ধ করে দেন ফুটবলবিশ্বকে, সেই মেসিই গোল করতে পারলেন না পেনাল্টি থেকে। আর্জেন্টিনার শিরোপা-ভাগ্যও যেন নির্ধারিত হয়ে গেল তখনই। চতুর্থবারের মতো বড় কোনো প্রতিযোগিতার ফাইনালে উঠেও শিরোপা জিততে পারলেন না এ সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার। ২০১৫ সালের মতো শতবর্ষী কোপা আমেরিকার ফাইনালেও চিলির বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হলো আর্জেন্টিনার। হার নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর মাঠেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন পাঁচবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার। নিজের পেনাল্টি মিস, দলের হার- সব মিলিয়ে মেসি যেন ডুবছিলেন দুঃস্বপ্নের জোয়ারে। তীব্র এক হতাশার ঘোরের মধ্যেই তিনি নিয়ে ফেললেন নাটকীয় এক সিদ্ধান্ত। জানিয়ে দিলেন, আর কখনোই খেলবেন না আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে।
২০০৪ সালে পেশাদারি ফুটবল ক্যারিয়ার শুরুর পর একের পর এক সাফল্য পেয়েছেন মেসি। তবে সব কিছুই স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে। গত ১২ বছরে জিতেছেন আটটি লা লিগা, চারটি কোপা দেল রে ও চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। লা লিগার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটিও নিজের করে নিয়েছেন। ২০০৯ সাল থেকে বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন পাঁচবার। কিন্তু বার্সেলোনার এই দুর্দান্ত মেসিকে কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া যায় না আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে।
২০০৫ সালে অভিষেকের পর আর্জেন্টিনার হয়ে ১১৩টি ম্যাচ খেলেছেন মেসি। ৫৫টি গোল করে গড়েছেন নতুন রেকর্ড। আর্জেন্টিনার পক্ষে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডে ছাড়িয়ে গেছেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে। কিন্তু দলীয় অর্জনের খাতাটি একেবারেই শূন্য। ২০০৮ সালে জিততে পেরেছেন শুধু অলিম্পিকের সোনা। সেটাকে অবশ্য বড় কোনো সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় না লাতিন আমেরিকান ফুটবল অঙ্গনে।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজের নামটি স্মরণীয় করে রাখতে হলে মেসিকে জিততে হতো কোপা আমেরিকা বা বিশ্বকাপ শিরোপা। কিন্তু দুটির একটিও ধরা দেয়নি মেসির হাতে। কোপা ও বিশ্বকাপ মিলিয়ে চারটি আসরের ফাইনালে গিয়েও হতাশ হতে হয়েছে এ সময়ের সেরা ফুটবলারকে।
আর্জেন্টিনার আকাশি-সাদা জার্সি গায়ে মেসির দুঃখগাথা শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে। পুরো টুর্নামেন্টে দারুণ নৈপুণ্য দেখালেও ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের কাছে ৩-০ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ও সেমিফাইনালে একটি করে গোল করলেও ফাইনালে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে বল পাঠাতে পারেননি মেসি। সেবার তিনি জিতেছিলেন সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কার।
তিন বছর পর, ২০১০ সালের বিশ্বকাপে মেসি ছিলেন অনেকটাই পরিণত। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের আশা ছিল, মেসির হাত ধরেই আসবে তাদের তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা। কিন্তু সেবার এই প্রত্যাশা পূরণের ধারেকাছেও যেতে পারেনি মেসির আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিয়েছিল জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে হেরে। পরের বছর, ২০১১ সালের কোপা আমেরিকাতেও মেসি হাসতে পারেননি সাফল্যের হাসি। এবারও বিদায় সেই কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। উরুগুয়ের কাছে টাইব্রেকারে হেরে।
২০০৭-এর পর ২০১৪ সাল থেকে নতুন করে শুরু হয় মেসির ফাইনাল দুর্ভাগ্য। সে বছরের বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচেই দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়ে নজর কেড়েছিলেন মেসি। সবচেয়ে বেশি চারবার জিতেছিলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। কিন্তু ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে হতাশ হতে হয় আর্জেন্টিনাকে। বিশ্বকাপ শিরোপাটা পাশে রেখে মাথা নিচু করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিতে গিয়েছিলেন মেসি। বিবর্ণ-মলিন হয়ে ছিলেন পুরস্কার বিতরণীর পুরোটা সময়।
এক বছর পর, বিশ্বকাপ শিরোপা জিততে না পারার আক্ষেপ ভুলতে না ভুলতেই আর্জেন্টিনা চলে যায় আরেকটি বড় আসরের ফাইনালে। একটি ম্যাচ জিতলেই মেসি পেয়ে যেতেন বহু আরাধ্য একটি আন্তর্জাতিক শিরোপা। কিন্তু ২০১৫ সালে কোপা আমেরিকা ফাইনালে চিলির বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরে আবারও শুধু হতাশই হতে হয়েছে আর্জেন্টাইন তারকাকে। ক্ষোভে-দুঃখে সেবার টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটাও গ্রহণ করেননি মেসি।
সব হতাশা দূর হয়ে যেতে পারত এ বছরের কোপা আমেরিকার শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ সংস্করণে। শিরোপাজয়ের জন্য লৌকিক-অলৌকিক কোনো চেষ্টাই বাদ দেননি মেসি। সৌভাগ্যের প্রতীক বিবেচনা করে দাড়ি কাটেননি। প্রথমবারের মতো মেসিকে দেখা গিয়েছিল মুখভর্তি দাড়িগোঁফ নিয়ে। মাঠের পারফরম্যান্সেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সবাইকে। ইনজুরি কাটিয়ে মাঠে ফিরে মাত্র ৩০ মিনিট খেলেই করেছিলেন হ্যাটট্রিক। ফাইনালের আগপর্যন্ত চার ম্যাচ খেলে নিজে করেছিলেন পাঁচটি গোল। সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছিলেন আরো চারটি। যেন প্রস্তুতই হয়ে ছিল মেসির শিরোপাজয়ের মঞ্চ। কিন্তু ফাইনালে আবারও সেই টাইব্রেকার দুর্ভাগ্য!
২০১৫ সালের মতো এবারও সেই চিলির বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরেই শিরোপাবঞ্চিত হতে হয়েছে মেসিকে। সেই আক্ষেপ থেকে আন্তর্জাতিক ফুটবলকেই বিদায় বলে দিয়েছেন পাঁচবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার। সত্যিই যদি এই সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তাহলে ফুটবল ইতিহাসে আক্ষেপের সুরেই উচ্চারিত হবে মেসির নাম।