ক্রিকেটারদের কাছে ভক্তদের আবেগ কি এতই সস্তা?
ক্রিকেট শব্দটা ইংরেজিতে লিখতে সাতটি বর্ণের প্রয়োজন হয়। সাত সংখ্যাকে ভাবা হয় সৌভাগ্যের প্রতীক। বাঙালির হাজার দুঃখ থাকলেও ক্রিকেট যখন মাঠে গড়ায়, সব ভুলে সবাই অভিন্ন প্রার্থনায় রত হয়। বাংলাদেশ দল জিতুক। দেশের ক্রিকেটাররা একেকজন সুপার হিরোতে পরিণত হয়েছেন ভক্তদের কাছে। আবেগের আগল খুলে দেয় সাধারণ মানুষ। তবে, সেই সুপার হিরোদের সাম্প্রতিক নানা কাণ্ডে প্রশ্ন জাগে— ক্রিকেটারদের কাছে ভক্তদের আবেগ কি এতই সস্তা?
গত বছর পুরোটা গিয়েছে তামিম ইকবালকে নিয়ে। অবসর নাটক, ফিরে আসা, অধিনায়কত্ব ছাড়া, তারপর বিশ্বকাপে না যাওয়া! গল্পের শেষ নেই। ওয়ানডে বিশ্বকাপে সবাই যখন দল নিয়ে আশায় বুক বেধেছে, তখন দৃশ্যপটে সাকিব আল হাসান। সাকিব-তামিম দেশের ক্রিকেটের দুই নক্ষত্র, অথচ তাদের আচরণ যেন সড়কবাতির মতো। একে অপরকে দোষারোপে বিশ্বকাপের আমেজটাই নষ্ট করে দিলেন।
বিশ্বকাপে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। এরপর তদন্ত হয়। তদন্ত কমিটি জানায়, এমন কিছু বিষয় তাদের হাতে এসেছে, যা প্রকাশ্যে এলে দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। এতটুকু কথাই কি যথেষ্ট নয়? সব ভুলে দর্শকরা আবার মাতে মাঠের ক্রিকেটে। তামিমের অবসরে অঝোরে কান্না করা, মাহমুদউল্লাহকে দলে ফেরাতে ভক্তদের মানববন্ধন, সাকিব-তামিম লড়াই, সব আড়াল হয় বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল)। বিপিএলে তামিম শিরোপা জিতেছেন, প্রথমবার শিরোপার স্বাদ পান মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ। তাদের চেয়ে বোধহয় ভক্তরাই বেশি আনন্দিত হয়েছিল। ক্রিকেটারদের অর্জন যেন প্রতিটি সাধারণ দর্শকের অর্জন।
বিপিএল শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে লড়াই করে হার, ওয়ানডে সিরিজ জিতে মধুর প্রতিশোধ। সব ফিরছিল কক্ষপথে। এমন সময়ে গতকাল মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) হঠাৎ করে ফাঁস হয় মেহেদী হাসান মিরাজের সঙ্গে তামিমের গোপন ফোনালাপ। রাতারাতি ভাইরাল হয় সেই কথোপকথন। যেখানে শোনা যায়, তামিমকে বাদ দিয়ে নতুন দল গড়ার ফন্দি আঁটছেন মুশফিকুর রহিম। যা নিয়ে তামিম ভীষণ চটেছেন। শঙ্কা তৈরি হয়, সাকিবের পর কি তাহলে মুশফিকের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ালেন তিনি?
গতকালের ফোনালাপের বিস্তারিত নিয়ে আজ সন্ধ্যা ৭টায় ফেসবুক লাইভে আসার ঘোষণা দেন তামিম। সময় মতোই লাইভে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন মিরাজ, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহকে। মাহমুদউল্লাহকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় ফোনালাপের বিষয়ে, তিনি তখন চোখ উল্টে এমন প্রতিক্রিয়া দেন, মনে হলো আকাশ থেকে পড়লেন।
মাহমুদউল্লাহ বলেন, ‘আমি তো কিছুই শুনিনি। জিনিসটা ক্লিয়ার হওয়া প্রয়োজন। মুশফিককে ডাকা দরকার।’ মিরাজকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মুশফিককে লাইভে আনতে। মুশফিক এলেন। এরপর যা ঘটে, তা রীতিমতো ভক্তদের আবেগ নিয়ে প্রহসন!
এর আগে কাল রাতের ফোনালাপ নিয়ে একটু আলাপ করা যাক। কী কথা হয়েছিল তামিম-মিরাজের মধ্যে? মুশফিককে উদ্দেশ্য করে মিরাজকে তামিম বলেন, ‘আমি এখন তোদের সাথে ন্যাশনাল টিমে খেলি না, তাই এত ভাবসাব বেড়ে গেছে অনেকের৷ সম্মান তো নাই-ই। সমস্যা নেই, সময় আমারও আসবে। পৃথিবীটা গোল, আজ তুই এদিকে আমি অন্যদিকে৷ কাল আমি একদিকে থাকব, তুই অন্যদিকে। সব হিসাব নেওয়া হবে৷ তোর ভাইকেও জানিয়ে দিস৷’
আজ সন্ধ্যার লাইভের দিকে তাকিয়ে ছিল আপামর ক্রিকেটভক্তরা। কিন্তু, তারা এভাবে ধোঁকা খাবে, নিশ্চয়ই ভাবতে পারেনি। আসল ব্যাপার হলো, ফোনালাপটি ছিল মূলত মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগদের একটি ক্যাম্পেইনের প্রমো। এবারের ইদুল ফিতর উপলক্ষে ২৪ জন ভাগ্যবান ঢাকায় জমি পাবেন। সেজন্য শর্ত হলো, অন্তত দুই বা তার বেশি লোকের একটি দল গড়তে হবে। সেখানেই তামিমকে ছেড়ে আলাদা দলে গেলেন মুশফিক। যার অংশ হিসেবেই এই ফোনালাপের নাটক সাজানো হয়। বোকা বানানো হয় ক্রিকেটপ্রেমীদের। তাই বলে টাকার কাছে তারকাদের বিকিয়ে যেতেই হবে?
নগদ আপাদমস্তক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। তারা ক্যাম্পেইন করতেই পারে। বিশ্বব্যাপী নেগেটিভ মার্কেটিংয়ের বাজার বেশ বড়। তাই বলে, দেশের বেশিরভাগ মানুষ যে খেলাটিকে উপজীব্য করে আনন্দের উপলক্ষ খোঁজে, আবেগের বিশাল জায়গাজুড়ে যার অবস্থান; সেই খেলাটি নিয়ে এমন ক্যাম্পেইন কতটা যৌক্তিক? সেখানে আবার তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, মিরাজরা সহাস্যে অংশ নিলেন!
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার আল-আমিন সাইফ। ক্রিকেটের প্রতি যার ভালোবাসা ছোটবেলা থেকে। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, আজ তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ ওরা লাইভে এসে যা করল; সেটি মানুষের আবেগ নিয়ে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। পঞ্চপাণ্ডবের প্রতি যে ভালোবাসাটা ছিল, সেটি দিন দিন কমে আসছে। লাইভের শুরুতে মাহমুদউল্লাহর অভিব্যক্তি দেখে পুরো অবাক বনে যাই। ভেবেছিলাম, সিরিয়াস কিছুই। আর তামিম বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তি। কিন্তু, ইদানিং মনে হচ্ছে নিজের মানটা নিজেই কমাচ্ছেন।’
জিয়াউল হক রিশাদ নামে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আরেক তরুণ বলেন, ‘ঠাট্টার ছলে গ্রামের দিকে একটা কথা বলা হয়, ‘কারও ঘর পোড়ে আর কেউ পোড়া ঘরে আলু পুড়ে খায়। নিসন্দেহে বর্তমানে পোড়া ঘরটার মালিক বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। পোড়া ঘরের কাঠখড়ের মধ্যে আলু পুড়ে খেল নগদ। বিসিবির এই চুপ থাকাটা অসহায়ত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে। মানুষের ইমোশনকে পুঁজি করেই চলে এদের পকেট ভারীর নৃত্য। তবে, এবারের ব্যাপারটা বেশিই বিদঘুঁটে।’
আবেগ মানুষের দুর্বলতা। সেটি শক্তিতে পরিণত না করে এভাবে হাসির খোরাকে পরিণত করাটা সত্যিই লজ্জাজনক। বিশেষত, সিনিয়রদের এমন আচরণে আগামীর তারকারা কী বার্তা পাচ্ছে, ভাবতে গেলে চিন্তা জড়ো হয়।