পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি গ্রেপ্তার
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী শাহ মাহমুদ কোরেশিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার (১১ মে) সকালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কোরেশির পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির (পিটিআই) টুইটারে শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা যায়, সাদা পোশাকের লোকেরা তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় উপস্থিত দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে হাত নাড়েন।
পিটিআইয়ের দাবি, ৬৬ বছর বয়সী শাহ মাহমুদ কোরেশিকে বৃহস্পতিবার ভোরে ইসলামাবাদ পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এবং তাকে একটি ‘অজ্ঞাত স্থানে’ নেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতি মামলায় পিটিআই প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের দুদিন পরে শাহ মাহমুদ কোরেশিকে গ্রেপ্তার করা হলো।
এদিকে, ইমরান খানের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ জানায়, বিক্ষোভে দেশটিতে আটজন নিহত হয়েছে এবং প্রায় এক হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। খবর বিবিসির।
কিছু এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে এবং জনতা তাদের সম্পত্তিতে হামলার পর কঠোর সতর্কতা জারি করেছে। দেশটির চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এই গ্রেপ্তার নাটকীয়ভাবে ইমরান খান এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। দোষী সাব্যস্ত হলে সাবেক ক্রিকেট তারকা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্ভবত আজীবনের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। এ বছরের শেষ দিকে দেশটিতে নির্বাচন হওয়ার কথা।
গত মঙ্গলবার (৯ মে) গ্রেপ্তার করার ফুটেজে দেখা যায়, কয়েক ডজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ৭০ বছর বয়সী ইমরান খানকে জোরপূর্বক আদালত থেকে সরিয়ে একটি পুলিশের গাড়িতে তুলেছেন। যে পুলিশ তাকে যেখানে আটক রেখেছে, সেখানে কঠোর নিরাপত্তা রয়েছে এবং সেই জায়গায় অস্থায়ী বিশেষ আদালত বসানো হয়েছে।
গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বেআইনিভাবে রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রি করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশনের মামলায় ইমরান খানকে অভিযুক্ত করা হয়। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি সব আইনি শর্ত পূরণ করেছেন। তার বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলার মধ্যে এটিই প্রথম, যেটিতে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করতেন ইমরান খান, তাকে জেলহাজতের বাইরে রাখতে পুলিশের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পরতেন তার সমর্থকরা।
ইসলামাবাদের কাছে আল-কাদির ইউনিভার্সিটির জন্য কথিত জমি হস্তান্তর সংক্রান্ত পৃথক দুর্নীতি মামলায় জারিকৃত নতুন ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে মঙ্গলবার ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ মামলায় তাকে আট দিনের রিমান্ডে নেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারক।
ইমরান খানের আইনজীবী শের আফজাল মারওয়াত বলেছেন, ‘তিনি (ইমরান খান) ভালো আছেন এবং সমর্থকদের কাছে হাল ছেড়ে না দেওয়ার জন্য একটি বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আপনাদের আইনের শাসনের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।’ ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) বলেছে, তার গ্রেপ্তারের বৈধতাকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হবে।
পাকিস্তানের দুর্নীতি বিরোধী সংস্থার এই পদক্ষেপ দেশটিতে সহিংস বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সরকার খাইবার পাখতুনখোয়া, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও ইসলামাবাদসহ দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সেনাবাহিনী নামিয়েছে।
জাতির উদ্দেশে এক টেলিভিশন ভাষণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ হুঁশিয়ারি দেন, সহিংস বিক্ষোভ সহ্য করা হবে না। যে দুষ্কৃতকারীরা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, তাদেরকে কঠোর হস্তে মোকাবিলা করা হবে।
মঙ্গলবার (৯ মে) সন্ধ্যায় ইমরান খানের সমর্থকরা লাহোরে কর্পস কমান্ডারের বাসভবন ভাঙচুর করছে এবং বিভিন্ন সম্পদ বিনষ্ট করেছে, যা তারা বলেছিল ‘নাগরিকের অর্থ’ দিয়ে কেনা হয়েছে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ৯ মে কে ‘অন্ধকার দিন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং রাষ্ট্রের সম্পত্তিতে আবারও হামলা হলে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করেছে।
সার্জিক্যাল মাস্ক পরা একজন বিক্ষোভকারী পাথর ও লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বলছিলেন, ‘আমরা একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করতে এসেছি, কিন্তু পুলিশ আমাদের দিকে শেল নিক্ষেপ করছে। আমরা আমৃত্যু এই আন্দোলন চালিয়ে যাব অথবা যতক্ষণ তারা ইমরানকে মুক্তি না দেবে। নইলে সারা দেশ অচল করে দেব।’
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদের চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ইমরান খানকে গত বছরের এপ্রিলে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। নভেম্বরে ওয়াজিরাবাদ শহরে জনতার মাঝে প্রচারণা চালানোর সময় তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। তিনি এই হামলা চালানোর জন্য একজন ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। সেনাবাহিনী দৃঢ়ভাবে অভিযোগ অস্বীকার করেছে। গ্রেপ্তারের একদিন আগে সামরিক বাহিনী ইমরান খানকে এই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি না করতে সতর্ক করেছিল।
ইমরান খানের দল পিটিআই বলছে, তার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হয়েছে, যেগুলো তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন। বর্তমান সরকার তাকে অক্টোবরে সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখতে চায়।
ইমরান খানের পিটিআই সরকারের সাবেক মানবাধিকারবিষয়ক মন্ত্রী ড. শিরীন মাজারি বলেন, ‘তাঁকে (ইমরান খান) যেভাবে আটক করা হয়েছে, তা রাষ্ট্রীয় অপহরণের শামিল। আমরা আশা করি না, সেনাবাহিনী এভাবে আদালতের পবিত্রতাকে নষ্ট করবে। পাকিস্তানের জনগণ তাঁর সঙ্গে যেভাবে আচরণ করা হয়েছে, তাতে ক্ষুব্ধ। পাশাপাশি দেশে রয়েছে ব্যাপক অর্থনৈতিক সমস্যা।’
তবে ইসলামাবাদের হাইকোর্ট ইমরান খানের গ্রেপ্তারকে বৈধ ঘোষণা করেছে। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী আহসান ইকবাল বলেন, ‘ইমরান খান আইনের মুখোমুখি হবেন, নির্দোষ হলে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। কিন্তু দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে।’
ইমরান খানের দলের মহাসচিব আসাদ উমরসহ বহু সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সারা দেশে মোবাইলফোনে ইন্টারনেট পরিষেবা সীমিত রয়েছে। পাকিস্তানের টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পরিষেবা স্থগিত করেছে।
এছাড়া স্কুলগুলো বন্ধ রয়েছে, কিছু মহাসড়ক অবরুদ্ধ করা হয়েছে এবং প্রধান শহরগুলোতে রাস্তায় সামান্য যানজট রয়েছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরান খান সেনাবাহিনীর সহায়তায় জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে তিনি সামরিক বাহিনীর আনুকূল্য হারান। পরমাণু অস্ত্রের দেশ পাকিস্তানে পর্দার অন্তরালের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় সেনাবাহিনী। ক্ষমতা হারানোর পর থেকে ইমরান খান সেনাবাহিনীর কঠোর সমালোচকদের একজন হয়ে ওঠেন।