জার্মানির শিল্পখাতে ক্রমাগত চীনের প্রভাব বাড়ছে৷ চীন শুধু জার্মানির ফল্কসভাগেন, মার্সিডিজের মতো গাড়ির বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই থেমে থাকেনি৷ কেমিক্যাল ও প্রকৌশল খাতেও বাড়ছে চীনের উপস্থিতি৷

সেন্টার ফর ইউরোপীয় রিফর্ম (সিইআর) এর একটি প্রতিবেদন বলছে, জার্মানির শিল্প কারখানার কাঠামো বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে৷ যে কারণে আগামী পাঁচ বছরে শিল্প উৎপাদন কমে গিয়ে ৫৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ও জিডিপির ২০ শতাংশ হুমকির মুখে পড়তে পারে৷

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জার্মানি তার দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনে৷ যে কারণে কেমিক্যাল ও ইস্পাতের মতো শিল্পের খরচ বেড়ে গেছে৷ আর সেই অবস্থায় বাড়তি চাপ তৈরি করেছে চীনের ‘মেড ইন চায়না ২০২৫' কৌশল- যা চীনের স্বল্প মূল্যের উৎপাদন থেকে উচ্চ-প্রযুক্তি শিল্পে রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করেছে এবং সেটি জার্মানির মূল অর্থনৈতিক খাতের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা করছে৷

শুরুতে জার্মানি চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি৷ কারণ, তারা প্রযুক্তিগতভাবে নিম্ন প্রযুক্তির পণ্য উৎপাদনে সীমাবদ্ধ ছিল৷ তবে বেইজিংয়ের শিল্প নীতি যখন থেকে জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ শিল্প যেমন মোটরগাড়ি, ক্লিন টেকনোলজি ও যন্ত্র প্রকৌশলে সম্প্রসারিত হয়েছে, তখন থেকে দেশটির প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে জার্মানিতে৷

চীনের দ্রুত অগ্রগতি সবচেয়ে স্পষ্টতই অটোমোবাইল বা গাড়ির শিল্পে৷ জার্মান গাড়ি নির্মাতারা বৈদ্যুতিক যানবাহনের দিকে ধীরগতিতে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে৷ একই সঙ্গে ব্যাপক ছাঁটাই এবং দেশীয় কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে দেশটিতে৷

জার্মানির যন্ত্র প্রকৌশল খাতেও এর প্রভাব পড়েছে৷ ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শিল্প যন্ত্রপাতি রপ্তানির বৈশ্বিক বাজার কিছুটা হ্রাস পেলেও চীনে অর্ধেকেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে৷ কিছু ক্ষেত্রে জার্মানিকে ছাড়িয়ে গেছে৷

জার্মান শিল্পগুলোর মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো চীনের ব্যাপক ভর্তুকি৷ ২০১৯ সালে চীনের শিল্প ভর্তুকির পরিমাণ ছিল আনুমানিক ২২১ বিলিয়ন ইউরো৷ যার মধ্যে রাসায়নিক, যন্ত্রপাতি, মোটরগাড়ি ও ধাতু শিল্পগুলো সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিল৷ ফলশ্রুতিতে চীনের নির্মাতারা কম খরচে উৎপাদন করতে পারছেন, যা জার্মান নির্মাতাদের জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তুলেছে৷

জার্মান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিগুলো চীনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে৷ কারণ চীন তাদের চেয়ে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কম দামে পণ্য সরবরাহ করতে পারে৷ চীনে জার্মান চেম্বার অফ কমার্সের একটি জরিপে দেখা গেছে অর্ধেকেরও বেশি জার্মান সংস্থা মনে করছে, চীনের কোম্পানিগুলো পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বে বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠবে৷

তবে অর্থনীতিবিদরা জার্মানিকে পরামর্শ দিচ্ছেন সকল ক্ষেত্রে আধিপত্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করার পরিবর্তে ওষুধ, জৈবপ্রযুক্তি ও জ্ঞান-ভিত্তিক শিল্পের মতো যেসব ক্ষেত্রে এখনও জার্মানির শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে সেগুলোতে মনোনিবেশ করা৷

ব্যবসায়িক নেতা ও নীতিনির্ধারকদের বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বিবেচনার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে৷ কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন ঝুঁকির মুখে থাকা শিল্পগুলোকে রক্ষা করার ওপর জার্মানির মনোযোগ উদ্ভাবনকে ধীর করে দিয়েছে৷

আগামী ১২ বছরে এক ট্রিলিয়ন ইউরোর প্রতিরক্ষা ও অবকাঠামো ব্যয় পরিকল্পনা জার্মানির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সাহায্য করতে পারে৷ তবে উদ্বেগ রয়েছে এই বিনিয়োগের একটি বড় অংশ উচ্চ-প্রবৃদ্ধির শিল্পকে উৎসাহিত করার পরিবর্তে সামরিক প্রকল্পগুলোতে ব্যয় হবে৷