পুতুলনাট্য একটি সৃজনশীল শিল্পকলা
পুতুলনাট্যে বিপুল পরিমাণ কল্পনার জায়গা রয়েছে। পুতুলনাট্য অনেক কিছুই উপস্থাপন করতে পারে, যা একজন শিল্পীর মনকে কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠতে সহায়তা করে। এই পুতুলনাট্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা শিশুদের প্রাকৃতিকভাবে কল্পনাপ্রবণ করে তোলা এবং বয়স্কদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে কাজ করে। এ কথা আমরা জানি, শিক্ষা সাধারণত উন্নয়নসদৃশ কাজকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র—এসব গণমাধ্যম শুধু দর্শক-শ্রোতা বৃদ্ধি করলেও তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ করাতে সমর্থ হয় না। এমনকি বিশাল পরিমাণ সস্তা খেলনার সুপ্রাপ্যতার কারণে শিশুরাও তাদের নব আবিষ্কার ও তাদের নিজস্ব খেলনা তৈরি করতে আগ্রহী হয় না। বয়স্করাও এতে আবদ্ধ, কারণ বিশ্বের অধিকাংশ কাজই বোধহীন ও পুনরাবৃত্তিকর। তাই মৌলিক অথবা উৎপত্তিগত কল্পনা এবং সৃষ্টিশীলতার জন্য শিশুদের সামান্য পরিমাণে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। আমাদের আধুনিক বিশ্বে কলা ও হস্তশিল্পের যথাযথ ব্যবহার ও গুরুত্ব ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এটা শুধু বয়স্কদের জন্য বিনোদন হিসেবে নয়, বরং শিশুদের জন্য সৃষ্টিশীল চিন্তার প্রশিক্ষণও বটে, যা ছাড়া কোনো বিষয় বা ক্ষেত্র অগ্রগামী হতে পারে না। মাঝেমধ্যে শিশুদের শিল্প শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন, যার ফলে শিশুরা সৃষ্টিশীলতার নীতিমালা উদঘাটন করতে আগ্রহী হবে।
এখানে পুতুলনাট্যের সঙ্গে আমার জ্ঞাতব্য হলো, আধুনিক জীবনের প্রয়োজনীয়তায় এটা কী অবদান রাখতে পারে? অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে এটার সম্পর্ক কী? এটার গুণগত মানই বা কী? এর উত্তরে বলা যায়, যখন কোনো পুতুলনাট্য দর্শকের সামনে প্রদর্শিত হয়, তখন দর্শকও এটাকে নাটকীয় উপস্থাপনা হিসেবেই দেখে। পুতুলনাট্য এবং দর্শকের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কারণে যতটা পারস্পরিক যোগাযোগ ঘটে, চলচ্চিত্র বা টেলিভিশনের ক্ষেত্রে ততটা পরিপূর্ণভাবে ঘটে না। অবশ্য মঞ্চে যা প্রদর্শিত হয়, তার একটা পরিপূর্ণ উপলব্ধি আছে। আর মঞ্চের এই সাফল্য দর্শকের প্রদর্শিত বিষয়ে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে নেতৃত্ব দেয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, শিশুরাই তাদের সৃষ্টিশীল কল্পনার মাধ্যমে পুতুলনাট্যের প্রথম সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। এখন আমরা পুতুলনাট্যের বিভিন্ন কার্যক্রম ও বিশেষত্ব সম্পর্কে চিন্তা করব যে এটা কীভাবে শিক্ষার সঙ্গে সর্ম্পকিত।
বলা যায়, নির্মাণের দক্ষতা, উপযুক্ত উপকরণের নির্ধারণ এবং কাল্পনিক ডিজাইন প্রভৃতির অভাবে পুতুল তৈরিতে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি মাঝেমধ্যে আমরা প্রযুক্তিগত দিকে প্রচুর সময় নষ্ট করি। শিশুদের যদি পুতুল তৈরিতে সুযোগ-সুবিধা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎসাহ দেওয়া হয়, তাহলে তারা তাদের হাতের কাছে যা পাবে তা দিয়েই খুব অল্প সময়ের মধ্যে পুতুল তৈরি করতে সক্ষম হবে। এ ক্ষেত্রে যদি তাদের স্বাধীন চিন্তাভাবনার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে প্রথম অবস্থায়ই ভালো ফল পাওয়া যাবে। যদি কখনো তাদের বিভিন্ন মানুষ, প্রাণী, পাখি প্রভৃতির অনুকরণ করতে বলা হয়, তাহলে তাদের পছন্দের ওপর ব্যক্তিগত ডিজাইনও নির্ভর করেবে।
চরিত্রায়ণের ফলাফলের সঙ্গে একটি সৃষ্টিতুল্য নাট্য তৈরি সম্ভব। এখানে সৃষ্টিশীল নাটকে কিছু কৌশল ব্যবহৃত হতে পারে। এটা প্রতিষ্ঠিত যে, শিশু নাটক এবং শিশু শিল্প উভয় প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বেড়ে ওঠে, যাতে শিশুদের সত্তা প্রকাশ পায়। আর এগুলো বয়স্কদের চাহিদা ও মতামতের দ্বারা পরিচালিত হয় না। একটি শিশুর অঙ্কনে এক ধরনের আবেগ ও আকৃতি প্রদর্শন হতে পারে। শিশুরা হলো প্রাকৃতিক অভিনেতার মতো। তারা বিভিন্ন যন্ত্র, প্রাণী, মানুষের কথা, শব্দ যথাযথভাবে নকল করে উপস্থাপন করতে পারে। তারা সমস্ত গল্পটাকে মঞ্চে অল্প পরিমাণ পোশাক ও অভিনয় উপকরণ দ্বারা উপস্থাপন করতে পারে। তারা বয়স্কদের ধারণা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয় না এবং তাদের উপস্থাপিত বিষয় দর্শককে দেখার আগ্রহ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
পুতুলনাট্যে শিক্ষার কোনো বিভাজন নেই, রুক্ষ মর্মপীড়াদায়ক আবৃত্তিও নেই এবং মঞ্চে প্রদর্শনের মতো কিছু নেই; কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে নাট্যের প্রদর্শনে অংশগ্রহণের জন্য অনেক সুযোগ রয়েছে। মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে একটি গল্পের স্বচ্ছ ধারণা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর ওপরেই নাট্যকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি দলের সবাই সবকিছু চালাতে জানে। আবার যেকোনো ব্যক্তিই অভিনয় করতে পারে। তাই নাটকের অংশগুলোর মধ্যে ঘটনার মোড় থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একটি মৌলিক কাজের পরিচালনার পক্ষে তা অনেক বেশি কার্যকর।
সৃষ্টিশীল নাটক যে শুধু দর্শকের জন্য প্রদর্শিত হবে, তা নয়। তার মধ্যে ব্যক্তিগত মূল্যায়ন থাকবে, যা দলের সদস্যদের কাজকর্মে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। অবশ্যই শিশুদের জন্য, এমনকি বয়স্কদের জন্য এটা তখনই ভালো কিছু হতে পারে, যখন এর পূর্ণ আত্মপ্রত্যয়-সহকারে ঘটনার চিত্রায়ণ এবং চরিত্রের ক্রমধারাবাহিকতা ঘটে। সৃষ্টিশীল নাটকের গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া-পাওয়া হলো, একেবারেই ব্যক্তিগত মূল্যায়ন এবং দলীয় দায়িত্ব, যা পুরো থিয়েটারের মৌলিক কাজ। যখন শিশুরা বুঝতে শেখে, তখন যদি তারা সৃষ্টিশীল নাটকের অভিজ্ঞতার আলোকে গতানুগতিক নাটক তৈরির জন্য প্রস্তুত হয়, সে ক্ষেত্রে তারা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক ভালো কৃতিত্ব প্রদর্শন করবে।
পুতুলনাট্যের সঙ্গে সৃষ্টিশীল নাটক কীভাবে সম্পর্কিত? এ বিষয়ে বলা যায়, মুক্তভাবে একটা দলের চরিত্র ঠিক করতে অন্য একটি দলের দ্বারা প্রভাবান্বিত করা যেতে পারে। তখনই ব্যক্তি-সংলাপের প্রশিক্ষণ এবং তার বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা-ই হোক, পুতুলনাট্য তার কলাকৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ প্রদর্শন করতে পারে। নাটকের উপাদান এবং চরিত্রগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে নাটকের নাটকীয় উত্তেজনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।
এই কৌশল বেছে নেওয়া হয়েছিল, কারণ এটা তখন আবশ্যকীয় ছিল। পুতুলনাট্যে তার নাটকীয় পরিস্থিতির ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ মানুষকে অতি সহজেই প্রভাবান্বিত করতে পারত। বিশেষ মেধা বিবেচনা করে, একটি অতি পবিত্র শিল্প হিসেবে নাট্যরচনাকে বিবেচনা করা অতি কঠিন এবং অধিকাংশ মানুষ এ পদক্ষেপ মেনে নিতে অনিচ্ছুক। তথাপিও শিশুদের কাল্পনিক কাজগুলো এবং নাটকীয় অবস্থাগুলো পুতুলনাট্যের চরিত্র হিসেবে তৈরি হতে পারে। সুতরাং সৃষ্টিশীল কাজের জন্য শিশুদের উৎসাহ প্রদানের ক্ষেত্রে পুতুলনাট্য এবং সৃষ্টিশীল নাটক যেমন মূল্যবান, তেমনি চিত্রাঙ্কন, ডিজাইন প্রভৃতিসহ শিল্পের অন্যান্য বিষয় যথেষ্ট মূল্যবান।
পুতুলনাট্যের এই সহজাত প্রবৃত্তি পুরোপুরি ব্যবহারের দ্বারা এবং ওই সব সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার মাধ্যমে পুতুল মানব অভিনেতার পর্যায়ে পৌঁছে যায় বলে মনে করা হয়। পুতুলনাট্য শুধু তাদের সৃষ্টিশীল উদ্দীপনা জাগিয়ে রাখতেই কাজ করে না, বরং এর দ্বারা অনেক বেশি সামাজিক উন্নয়নও সাধিত হয়।
সবশেষে বলা যায়, সৃষ্টিশীল নাটকের কৌশলগুলো একত্র করার দ্বারা আমরা মানব প্রয়োজনে সৃষ্টিশীল বিকাশের জন্য গভীর শিকড় নির্মাণ করতে পারি। যা আজকের বিশ্বে, অর্থাৎ নগরায়ণ বা প্রযুক্তির বিস্তারকালে আমরা অবহেলা করতে পারি না।
(মূল রচনার শিরোনাম The Creative values of Puppet Theatre, এটি অনুবাদ করেছেন এস এম আবদুল্লাহ আল মামুন)