গল্প পড়ার গল্প
নয়নচারা, কেরায়া ও সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর গল্প
লাল শালু, কাঁদো নদী কাঁদো এবং চাঁদের অমাবস্যা, এই তিন উপন্যাস এবং অসামান্য কিছু গল্পে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ অখণ্ড বাংলার সাহিত্যে এক মহৎ জায়গা নিয়ে আছেন। ১৯২২ এ অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহরে জন্ম সৈয়দ ওয়ালিল্লাহর, মৃত্যু ১৯৭১ সালের অক্টোবরে প্যারিসে। তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ স্বল্পায়ু ছিলেন, কিন্তু তাঁর লেখক জীবনের আয়ু কম নয়। ২৫ বছর। ১৯৪৫-এর মার্চে তাঁর ২৩ বছর বয়সে কলকাতায় প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘নয়নচারা’ প্রকাশিত হয়। প্রথম উপন্যাস ‘লাল শালু’ ১৯৪৯-এ, ঢাকা থেকে।
ওয়ালিউল্লাহ ঠিক কাহিনী কথক ছিলেন না। মানুষের মনের গভীরে ছিল তাঁর যাতায়াত। বলা যায় তিনি জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃত উত্তরসূরী ছিলেন। তাঁর গল্প ছিল চেতনা প্রবাহের উজ্জ্বল উৎসার। কিন্তু বিষয় ছিল আমাদের এই দেশ, কাল, মাটি। লাল শালু কিংবা কাঁদো নদী কাঁদো, এই দুই উপন্যাস তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনি পূর্ব বঙ্গকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন, এঁকেছেন সেই অনুভবের কথা। দরিদ্র অন্ত্যজ নিরূপায় মানুষ ছিল তাঁর গল্প ও উপন্যাসের চরিত্র। সময় তার অভিঘাত নিয়ে ওয়ালিউল্লাহর গল্পে আর উপন্যাসে এসেছে।
১৯৪৫-এ প্রকাশিত নয়নচারা গল্পটিতে ১৩৫০-এর মন্বন্তরের পটভূমি। ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষে গ্রাম উজাড় হয়ে এসেছিল শহরে। এখানে একটি ক্ষুধার্ত পরিবার শহরে এসেছে। সেই শহরের কালো রাস্তা, অন্ধ রাত, তারায় ভরা আকাশের ভিতরে ময়ূরাক্ষী নামের এক নদীর তীরের মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। কালো রাস্তাকে মানুষটির মনে হয় অন্ধকারের নদী। সে ঘুম, নির্ঘুমের ভিতরে রাত পার করে। তার ভিতরে অবিরত বিভ্রম। মনে পড়ে নদীর জোয়ার ভাটা, নদীর ভিতরে জেলে নৌকা, মাছ, টাকা, অন্ন। যে গ্রাম, যে নদী, যে জীবন ছেড়ে এসেছে তাই তার স্বপ্ন আর বিভ্রম। ১৩৫০-এর মন্বন্তর নিয়ে, ভাত কাপড়ের অভাব নিয়ে গল্প পড়েছি আমরা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত প্রমুখ লেখকের। ওয়ালিউল্লাহর গল্প, ২২-২৩ বছরের এক তরুণ লেখকের গল্প ছিল একেবারে অন্য রকম ভাবে অনুভূত সেই অন্নাভাব।
ভূতো, ভূতনি, আমু শহরে এসেছে ভাতের জন্য। কিন্তু শহর বড় নিষ্ঠুর। শহরের মানুষের চোখ নেই। অন্ধ। অন্ধ চোখে তারা নকল চোখ লাগিয়ে নেয়। তারা অভাবী, ক্ষুধার্ত মানুষ সেই চোখে দেখতে পায় না। শহরের মানুষ হিংস্র, তাদের চোখে বৈরিতা, শহরের কুকুরগুলোর চোখে কিন্তু বৈরিতা নেই, আমুর তাই মনে হয়। গ্রামে ছিল এর বিপরীত। শহরে তো কুকুরের সঙ্গে ক্ষুধার্ত মানুষ অন্ন ভাগ করে খায়। আমু ভাবে আকাশের যে তারার নিচে তারা নয়নচারা গ্রামে বাস করত, সেই তারারা এখানে নিষ্ঠুর। সেই তারারাই তো দেখছে মানুষ এভাবে পড়ে আছে পথে-ঘাটে। নয়নচারা গল্পে কী ভয়ানক ভাবে চিত্রিত হয়েছে শহর। ইটের দেশ, খর রৌদ্রে প্লাবিত হয়ে অসহ্য সারাদিন।
লঙ্গরখানায় কদিন আগে ভাত পেয়েছিল, তারপর ক্ষুধায় জ্বলছে। এহেন সেই আমু শহরের নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের ভিতর হাঁটতে হাঁটতে একটি বাড়ির ভিতর থেকে সাড়া পায়। অন্ন নিয়ে দাঁড়িয়েছে বউটি। আমু কাপড় পেতে দিয়েছে। শহরে এই অভিজ্ঞতা তার হয়নি। সে তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, নয়নচারায় বউয়ের বাড়ি ছিল কি না। আহা, সেই বউটি অবাক হয়ে আমুর দিকে তাকিয়ে থাকে। আমু তো জানে শহর এমন পারে না। শহর নিষ্ঠুর, অন্ধ। কিন্তু নয়নচারা তার বিপরীত। গল্প এইটুকু। লিখনে গভীর হয়ে অন্তরে প্রবেশ করে।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর প্রতিটি গল্পই পাঠকের নিমগ্নতা প্রত্যাশা করে। স্রেফ কাহিনী লেখেননি তো তিনি। কাহিনী সামান্য, হয়তো কিছুই না, সামান্য এক অনুষঙ্গ, মুহূর্ত, একটি মনন প্রবাহই তাঁর গল্পের বিষয়। কিন্তু কোনো গল্পই এই দেশ, সময়কাল, জীবনের বাইরে নয়। ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে এক স্মরণীয় গল্প। আমি বলছি অন্য আর এক গল্প ‘কেরায়া’র কথা। গুড়ের কলসি বহন করে কেরায়া নৌকায়। মহাজন সেই গুড়ের কলসি দিলে দুই মাঝি নৌকা ছাড়বে। তারা হাটে এসেছিল গুড় নিতে। কিন্তু মহাজনের কথাই সার। সে আর আসে না গুড় নিয়ে। মাঝি দুজন খালি নৌকো নিয়ে এসেছিল, খালি নৌকো নিয়েই ফিরবে। এমন হয় কখনো। আবার হয়ও না। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে পরিবার নদীর দিকে চেয়ে। নৌকা ভরে নিয়ে ফিরবে তারা। তাদের সঙ্গে নৌকায় আছে একটি এতিম বালক। সে খাটাখাটনি করে। পরিবর্তে খেতে পায়।
এর ভিতরে নৌকায় উঠে এসেছে এক মৃত্যুপথযাত্রী বুড়ো। উঠে নৌকার অভ্যন্তরে পাটাতনে শুয়ে কাতরাচ্ছে। সে মরে যাবে। তার ইচ্ছে তার জীবনের এই আশ্চর্য ঘটনাটি তার পরিবারের সবাই দেখুক। তাদের সম্মুখে হোক। নৌকা তো ওই পথে যাবে। যাওয়ার পথে তাকে যেন তার গাঁয়ে নামিয়ে দিয়ে যায়। সে যখন মরতে যাচ্ছে, নৌকার মাঝিদের কাছে কী আর বলা। না বলেই উঠে এসে পাটাতনে শুয়ে পড়েছে। মাঝি দুজন তা দেখেছে, কিছুই বলতে পারেনি। তারা আছে গুড়ের জন্য বসে। মহাজন কি আসবে না? গুড়ের কলসের জন্য যদি অপেক্ষা করতে না হতো, বুড়োকে হয়তো জীবিত অবস্থায় তার গাঁয়ে নামিয়ে দিয়ে যেতে পারত তারা। কিন্তু তা হয়নি। তারা নৌকা নিয়ে বসে আছে। বুড়ো পাটাতনে শুয়ে মরতে যাচ্ছে।
এতিম বালকটি সেই মুমূর্ষু বুড়োর পায়ের কাছে শুয়ে ঘুমোয়। দুই মাঝি উপরে বসে থাকে। মরতে মরতে সামান্য সময়ের জন্য জেগে ওঠে বুড়ো। পা দিয়ে ঠোকর মারে বালকটিকে। ছেলেটি জাগে না। তার ঘুম গভীর। বুড়ো সেই অবস্থায় ভাবতে পারে সবই যেন মৃত্যু। সেই রাত, কাঠের পাটাতন, ছেলেটি। সব মরে ভূত। বুড়োর একটি ছেলে ছিল। সে সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিল। তার পায়ের কাছের ছেলেটি যেন সেই ছেলে। ছেলেটি ঘুমোয়। কেন না ঘুমই হলো মৃত্যু।
ওয়ালিউল্লাহ লেখকের লেখক। কী বিস্তার তাঁর লিখনে। মৃত্যু জীবনের মতো নয়। জীবনের সব আছে, মৃত্যুর কিছুই নেই। কোনো অনুভূতিই নেই। তাই বুড়ো, যে কি না মৃত্যুর ভিতরে ডুবে আছে, সজোরেই লাথি মারে ছেলেটিকে। তার ঘুম ভাঙে। বুড়ো তাকে ডাকতে চায়। পারে না। সে জানে এই ছেলেটি তার নয়। নয় কেন না সে বেঁচে আছে, তার ছেলেটি নেই। চারদিকে মৃত্যু তবু একে সে ডাকে। কী অনুভূতিময় বাক্য এই গল্পের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। রাত্রি বলে কিছু নাই। দিনের ওপারে মৃত্যু।
বুড়ো মরার আগে ছেলেটিকে বাপজান বলে ডেকে উঠেছিল। কিন্তু টের পেয়েছিল, এ তার ছেলে নয়। তখন সে চোখ বোঁজে চিরকালের মতো। তার মৃত্যু ঘটে। মৃত দেহটি পাটাতনে ঘুমোয়। তার পাশে এক মাঝি এসে ঘুমোয়, তখন অন্যজন জেগে থাকে। তারপর অন্যজন ঘুমোয় এসে মৃতের পাশে।
শেষে মহাজন না আসায় গুড়ের কলসের পরিবর্তে তারা মৃত লোকটিকে নিয়ে রওনা হয়। রাত্রিকালে সেই গাঁয়ে এসে নৌকা বাঁধে। নদী ঘাটে যারা ছিল তাদের দিয়ে খবর করে। বিনবিন করে কাঁদতে কাঁদতে বুড়োর পরিবারের মানুষরা আসে। তারা দেহটি নিয়ে গাঁয়ের ভিতরে চলে যায়। মাঝিরা নৌকা ছাড়ে। দুই মাঝি কেরায়া নৌকার দুই পাশে বসে থাকে। ছেলেটি আগের দিনের জায়গায়, পাটাতনে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নদীর জল ছলছল করে। এই গল্প বাংলাদেশেরই গল্প। ওই নদী, কেরায়া নৌকা, মরে যাবে জেনে নৌকায় এসে শুয়ে পড়া মানুষটি... এই সব কথা আমাদের জানা নেই। আর এই লিখনও না।