গল্প পড়ার গল্প
জীবনকে চিনিয়ে দেন সন্তোষকুমার ঘোষ

সন্তোষকুমার ঘোষ ২৮ বছর আগে, ১৯৮৫ সালেই চলে গেছেন। তখন তাঁর পঁয়ষট্টি। বাংলা সংবাদপত্র আর সাংবাদিকতা সন্তোষকুমারকে মনে রাখবে যে তা আমি বারবার শুনি। তিনি সংবাদ পরিবেশন আর লিখনে নতুন এক ধারা এনেছিলেন জানি। সে কথা অন্য। আমি সন্তোষবাবুর সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছি। একবার টানা ঘণ্টা দুই-আড়াই তো হবে। তিনি আর আমি। বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকায় সে ছিল আমার প্রথম গল্প। সন্তোষকুমারের লেখা পড়ে ভালো লেগেছিল। আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন আরেক বিখ্যাত লেখককে বলে। আমায় স্নেহময় এক অগ্রজ লেখক আনন্দবাজার পত্রিকায় সন্তোষবাবুর ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি সামনে, আমি টেবিলের উল্টোদিকে। দামি সিল্কের পাঞ্জাবি, ধুতি আর জরদা, সন্তোষ কুমার ঘোষের পাণ্ডিত্য, আর অনুভবী মনের যে পরিচয় পেয়েছিলাম আমি সেদিন, মনে থাকবে বাকি জীবন।
‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘শেষ নমস্কার’ উপন্যাস চিরাচরিত আখ্যান থেকে আলাদা যেমন ছিল, সন্তোষকুমার তাঁর ছোটগল্পে ছিলেন অতি আধুনিক। এখনো তাঁকে পড়লে তা ধরা যায়। চেনা যায় পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের সেই আমাদের পুরোনো দিন, পুরোনো শহর। দেখতে পাই মন্দার দিনে হাড়পাঁজর বের করা দাম্পত্য আর সমাজ। দেখার যে চোখ ছিল তাঁর, অনন্য তো নিশ্চয়। ১৯৫০-এর ঠিক আগে পরের সময়ের অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারি আর সেই সময়ের গ্যাসবাতি জ্বলা পুরোনো কলকাতা আর নগরজীবনকে তিনি যেভাবে ধরেছিলেন তাঁর গল্পে-উপন্যাসে, তা ছিল সবার থেকে আলাদা। সন্তোষকুমারের তুলনা তিনিই। মনে পড়ে সেই জাদুঘর, কানাকড়ির কথা। আমি ‘কানাকড়ি’ গল্পটির কথা বলি। এ এক দম্পতির কথা, যারা বাসা খুঁজে খুঁজে সস্তায় শেষ পর্যন্ত আহিরিটোলায় এসে উঠেছে। এ জায়গায় মাটি নেই, শুধু পিচ আর পাথর। শুধু ঘরবাড়ি। সাবিত্রি মন্মথর সংসারে অভাব খুব। তাদের পাশের ঘরে থাকে একা মল্লিকা, যাকে দুপুরে নিতে আসে একটি ট্যাক্সি। ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে আসে জুতো মসমস সুট-বুট একটি লোক। তারা নতুন সেই বাসাতে যাওয়ার পর একদিন ভুল করে তিন টোকা পড়েছিল সাবিত্রির ঘরে। পাশের ঘর থেকে চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এসেছিল, ও ঘর নয়, এই ঘর, ভুল করে ফেললে! তারপর হাই হিল খটখটিয়ে পাশের ঘরের সেই রমণী বেরিয়ে যায়। ট্যাক্সি চলে যায়। সে মল্লিকা। সাবিত্রির সঙ্গে তার আলাপ হয়। ঠেকিয়ে রাখে কী করে সে? মল্লিকাকে যে নিতে আসে সে কখনো তার মাসতুতো ভাই, কখনো বা হয় মামাতো ভাই। তাতে সাবিত্রি বুঝে যায় আসলে মল্লিকা কী করে। সে যতই অভাবী হোক, অমন হবে না কখনো। তারা গরিব হতে পারে, কিন্তু তাদের অন্তরটা খাঁটি—কথাটা সাবিত্রির স্বামী মন্মথ বলে। আসলে অভাবী মানুষের ওইটাই হলো সম্বল। সে খাঁটি তাই গরিব। কিছুতেই সে নিজেকে ছোট করবে না। ওই যে ওই মল্লিকা, তার ঘরে গান-বাজনার আসর বসবে, সে ঘর সাজাচ্ছিল। খুকিকে বুকের দুধ দিতে দিতে মল্লিকার ঘরে এসে অবাক হয় সাবিত্রি। মল্লিকা বলে, সে কজনকে নেমতন্ন করেছে, তারা তার গান শুনবে। সাবিত্রি শুনছে, তখনই সেই মামাতো বা জ্যাঠতুতো ভাই, আসলে যে মল্লিকার বাবু, সেই শশাঙ্কবাবু দরজায়। মাথায় কাপড় তুলে মেয়ের মুখ থেকে বুক সরিয়ে নিয়ে কোনোরকমে ব্লাউজের হুক আটকে বেরিয়ে আসতে আসতে সাবিত্রি টের পায়, সে ওই লোকটার চোখে ধরা পড়ে গিয়েছে। ‘ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেল বুঝি। অসম্বৃত গিলে আস্তিন আদ্দির জামাটা বুঝি সেঁটেই রইল আঁচলে, হিরে ঠিকরানো আঙুলের শর বিঁধে রইল পিঠে, ঠিক যেখানটায় ব্লাউজটা ফেঁসে গেছে।’ সন্তোষকুমারের কলমের ধার খুব। আঁচড়ে আঁচড়ে তিনি বেআব্রু জীবনকে চিনিয়ে দিতে পারতেন। ভিতর ও বাহিরের কলুষতাকে খুঁজে বের করে দিতেন।
সেদিন পাশের ঘরে বাজল হারমোনিয়াম আর উঠল হল্লা। ঘুঙুরের শব্দ শোনা গেল। সদাগরি অফিসের কেরানি মন্মথ বাড়ি ফিরে দরজা-জানালা সব বন্ধ করে কানে আঙুল দিয়ে হম্বিতম্বি করতে লাগল, বাড়িওয়ালার কাছে যাবে, এ কেমন ভাড়াটে। সাবিত্রি বলে বাসা দ্যাখো। এটা খারাপ পাড়া। হু, দেখবে মন্মথ, কিন্তু কী করে দেখবে, তার অফিসে যে গোলমাল চলছে। চাকরি থাকে কি-না ঠিক নেই। অভাব এলো হিংস্র শ্বাপদের মতো। ছাঁটাই হয়েছে মন্মথ। কী ভয়ানক সেই ছবি এঁকেছেন সন্তোষকুমার এই গল্পে। এই গল্প যেন সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের পৃথিবীর আখ্যান রচনা করেছে। চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছে মন্মথ, তার পায়ের জুতো ছিঁড়েছে, খালি পা। আগে মল্লিকা বলেছিল, সাবিত্রিকে শশাঙ্কবাবুর চোখে পড়েছে। লোকটা সিনেমা করে, সাবিত্রিকে একটা ছোট পার্ট দিতে চায়। সাবিত্রি তখন ঘেন্না লেগেছিল। ইশ! মল্লিকাকে বলেছিল, তুই মর মল্লিকাদি। সেই সাবিত্রি এরই ভিতর আবার গর্ভবতী হয়। তাকে বাপের বাড়ি মানে দাদার সংসারে পাঠিয়ে মন্মথ কাজ খুঁজে বেড়ায়। সাবিত্রি ফিরে আসে গর্ভপাত হয়ে যাওয়ায়। তার যে লাবণ্য ছিল যৌবনের তা মুছে গেছে। এদিকে অভাব তো সবকিছুকেই গ্রাস করতে চায়, করেও। মল্লিকা একদিন যায় রেসের মাঠে, সেখানে পাঁচ টাকা লাগালে পাঁচশ হতে পারে। তা শুনে সাবিত্রি তার জমানো পাঁচ আনা পয়সা মল্লিকার হাতে তুলে দেয় রেসে লাগানোর জন্য। আট আনা পায় সাবিত্রি। সে লাভ করেছে। আর তা শুনে মন্মথের ভেতরে জেগে উঠেছে গরিবের নৈতিকতা। সে সাবিত্রিকে ভর্ৎসনা করে। সাবিত্রি মাথা নিচু করে থাকে। অভাবী হতে পারে, কিন্তু তারা খাঁটি। কিন্তু অভাব এমন হয় যে সাবিত্রি একদিন মল্লিকাকে বলে, সেই সিনেমার পার্টটা যদি সে পেত, করবে।
মল্লিকা একটি সিনেমার টিকেট দেয় তার হাতে, সিনেমায় শশাঙ্কবাবু আসবে, কথাটা তাকে নিজেই বলুক সাবিত্রি। গর্ভ নষ্টের পর সাবিত্রির রূপ গেছে। সিনেমা হলের ভেতর তাকে দেখে শশাঙ্ক অবাক। সাবিত্রি বলে, মল্লিকার শরীরটা ভালো নেই, তাই তাকে টিকেটটা দিয়েছে। হল অন্ধকার হয়। সাবিত্রি কুঁকড়ে থাকে। মনে হয় তার পাশে বসা শশাঙ্ক তাকে বেড় দিচ্ছে, তার গায়ে বুঝি পড়ল একটি রোমশ হাত। বিরতি হয়। আলো জ্বলে। শশাঙ্ক ঠিকই বসে আছে। আবার আলো নিভলে সেই এক ভয়। শশাঙ্ক তাকে আবার...। সিনেমা শেষ হয়। শশাঙ্ক খুব স্বাভাবিক। সাবিত্রিকে কিছু না খাইয়ে ছাড়বে না। পর্দা ঢাকা কেবিনের ভেতর দুজনে বসে। তখন কথাটা বলে সাবিত্রি। সেই যে ছোট একটি রোল, সিনেমা। সেই সিনেমা তৈরি হয়ে গেছে। আর নতুন সিনেমায় তো—শশাঙ্ক সাবিত্রিকে তীক্ষ্ণ চোখে দ্যাখে। উঁহু, হবে না। নায়িকা তো নয়ই, কোনো পার্টই সাবিত্রিকে মানাবে না। শশাঙ্ক তাকে জরিপ করেছে ভালো করে। তারপর ওই কথা।
সাবিত্রিকে সে পৌঁছে দিতে চায় ট্যাক্সিতে। সাবিত্রি রাজি হয় না। হেঁটে ফেরে মনে আতঙ্ক নিয়ে। মন্মথ তাকে যে কী করবে আজ। যদি সে না ফেরে চেপে যাবে সাবিত্রি। কিন্তু বাড়ি ফিরে দ্যাখে সে আছে আর জানে সব। মল্লিকা তাকে বলে গেছে লজেন্স-বিস্কুট দিয়ে খুকির কান্না থামাতে এসে। সাবিত্রি দ্যাখে মন্মথ রাগেনি এতটুকুও। কিন্তু মন্মথ যখন শোনে সাবিত্রি রিফিউজ করেছে শশাঙ্কর ট্যাক্সিতে করে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব, রেগে গেল। কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করল বউকে, সে কি কচি খুকি, ভয়ের কি আছে, শশাঙ্কবাবু খুশি হতো। এই বাজারে যদি একটা কাজ দিতে পারে লোকটা, তাতে কত উপকার। তারা বাঁচবে। সাবিত্রি কি জানে না, কিসে নিজের ভালো হয়?
সাবিত্রির কিছুই রইল না। শশাঙ্কর কাছে যেমন তার রূপের আর শরীরের কোনো দাম নেই বুঝে এসেছে, অন্ধকারে একসঙ্গে পাশাপাশি বসে আর সিনেমার পার্টের কথায়, মন্মথর কাছেও তার ভেতরের পবিত্রতার কোনো দাম নেই। তাহলে তার থাকল কী? নিজের বলতে কানাকড়িও না। কত বড় ভুল আজ ভাঙল তার!
এই সন্তোষকুমারে গল্প। এই গল্পের নিষ্ঠুর জীবন আমাকে এখনো স্তম্ভিত করে।