সিমনকে সার্ত্রের প্রেমপত্র
জাঁ পল সার্ত্রে একজন প্রভাবশালী ফরাসি দার্শনিক, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিককর্মী। নোবেল পুরস্কারের মতো স্বীকৃতিকেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সারা পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তার করা সার্ত্রে নিজে প্রভাবিত হয়েছিলেন সিমোন দে বুভোয়ার দ্বারা। স্কুল পড়ুয়াদের মতোই প্রেমে পড়েছিলেন সার্ত্রে! তাঁর চেয়ে তিন বছরের ছোট সিমোন ছিলেন একজন ফরাসি লেখিকা, বুদ্ধিজীবী ও নারীবাদি তাত্ত্বিক।
১৯২৯ সালে সার্ত্রের বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। হৃদয়ে ছিল নবীন প্রেমের ধারা। সেই প্রেম উঠে এসেছিল সার্ত্রের কলমে, ২১ বছরের সিমোনের জন্য। সার্ত্রের প্রেম এতই গাঢ় ছিল যে সিমোনকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সিমোন বিয়েতে রাজি হননি। তবু তাঁরা একসাথে ছিলেন বাকি জীবন। তাঁদের এই প্রেম ছিল আকাশের মতোই খোলা এবং উদার। সিমোনকে লেখা সার্ত্রের সেই চিঠিই তাদের প্রেমের কবিতা। ব্রেইন পিকিংস ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া এই চিঠি ভালোবাসা দিবসে হতে পারে প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য এক দারুণ উদ্দীপনা।
আমার প্রিয় পিচ্চি,
অনেকদিন ধরেই একটা সন্ধ্যাজুড়ে তোমাকে চিঠি লিখতে চাচ্ছিলাম। সন্ধ্যার সেই সব হৈ হুল্লোড়, আড্ডা যেগুলোতে থাকলে মনে হয় পৃথিবীটা আমরাই চালাই। আমি আমার সেই বিজয় তোমার পায়ে রাখতে চাই। রাজ্য জয়ের সেই আনন্দ নিয়ে সব চিৎকার-চেঁচামেচি শেষে আমি ঘুমাতে যাই।
আজকে আমি তোমাকে এমন এক আনন্দের কথা বলব যেটা তুমি এখনো জান না। বন্ধুকে ভালোবাসার যে সুখ তা অতুলনীয়। শক্তির চেয়ে আবেগের যে শান্তি তা তোমাকে বোঝাতে চাই আমি। তোমাকে আমি এমনভাবে ভালোবাসতে চাই যা তুমি এর আগে আমার মধ্যে খেয়াল করনি। আমি হৃদয়ের এই ভ্রমণে ক্লান্ত নই, তোমার কামনায় নিজেকে গুটিয়ে নেইনি।
আমি আমার সব ভালোবাসাসহ নিজেকে তোমার কাছে সমর্পণ করলাম। ভালোবাসার কথা তোমাকে আমি মুখে বলেছি, কিন্তু লেখা হয়নি কখনো। আমাকে বুঝতে পারলে দেখবে, সারা পৃথিবীর খেয়াল রাখার মাঝেও আমি তোমাকে কতটা নির্জনে ভালোবাসি। আমি তোমাকে শুধুই ভালোবাসি। আজকের এই বসন্তের সন্ধ্যায় আমি তোমাকে ভালোবাসি। জানালা খোলা রেখে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার এবং এই সবকিছুই আমার। আমার চারপাশে যা আছে তার বিনিময়ে এই ভালোবাসা, এই ভালোবাসার বিনিময়ে আমার চারপাশের পৃথিবী টিকে আছে।
আমার প্রিয় পিচ্চি, তোমাকে তো আগেই বলেছি, তোমার বন্ধুত্বে ঘাটতি আছে। কমতি কাটিয়ে ওঠার জন্য তোমাকে কিছু বুদ্ধি দেই। তুমি বরং কোনো মেয়েবন্ধু খুঁজে নাও! তোমার অবশ্য তাকে আলাদা করে ভালোবাসতে হবে না। আমি বুঝি না, তুলুস শহরটা কীভাবে তোমার মতো একটা চালাক মেয়েকে ধরে রাখতে পারল না?
তুমি সব সময়েই ভালোবাসার জন্য প্রস্তুত, তোমার কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়া সবচেয়ে সহজ। আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার কথা বলছি না। বলছি ছোট ছোট বিষয়ের প্রতি তোমার ভালোবাসার কথা। তিভিয়ার রাস্তায় এক সন্ধ্যায় পাহাড়ের পাশ ঘেষে আঁকাবাঁকা রাস্তায় হাঁটছিলাম, মনে আছে? গায়ে গা লাগিয়ে অন্ধকারে হাঁটছিলাম আমরা। এরপর এক দমকা হাওয়া তোমাকে ছুঁয়ে গেল, তুমি তাকেও ভালোবেসে ফেলেছিলে।
আমি সেই অনুভূতিটা বোঝার চেষ্টা করেছি। যার মধ্যে আবেগের লেশ মাত্র নেই, শুধু দুজন মানুষ একসাথে থাকলে প্রচ্ছন্ন ভালো লাগার যে অনুভূতি কাজ করে সেটা আছে ভরপুর। এটা আরো বেশি কঠিন। সব বন্ধুত্বেই প্রচণ্ড ভালোবাসার একটা টান থাকে। এমনকি দুজন পুরুষের বন্ধুত্বের মধ্যেও ভালোবাসা থাকে।
আমি অসহায়ের মতো তোমার প্রেমে পড়ে গেছি, আমি নিজেকে থামাতে পারিনি। এটা এক ধরনের দুর্বলতা, যা আমি তোমার প্রতি বোধ করেছি। আমার মনে হয় এই অনুভূতিকে অনুভব করার মতো ক্ষমতা তোমার রয়েছে এবং তোমার তা ছুঁয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু মানুষের প্রতি তোমার ক্ষণস্থায়ী বিদ্বেষের কারণে তুমি তা ভুলে গেছ? তুমি কি ভেবে দেখেছ, একটা মেয়ের খোঁজে পুরো তুলুস শহরটা চষে ফেলা কতটা উত্তেজনার হতে পারে?
আশ্চর্য সেই মেয়েটা তুমিই। অথচ দেখ তুমি নিজেই নিজেকে ঠিকমতো ভালোবাস না। ভালোবাসার শরীরি দিক নিয়ে চিন্তা করো না, সামাজিক অবস্থান নিয়েও মাথা ঘামিও না। সৎভাবে খোঁজ। যদি নিজের প্রতি ভালোবাসা খুঁজে না পাও তবে হেনরি পস হয়ে যাও! সবেমাত্র তুমি যার খোঁজ পেয়েছ!
আমার সব দিয়ে তোমাকে ভালোবাসি।
(মজার বিষয় এই চিঠিতে সার্ত্রে নিজের কিংবা সিমন কারো নামই উল্লেখ করেননি।)