হুমায়ূন স্মরণ
বই খুললেই তোমাকে পাই
১৯ জুলাই উপলক্ষে একটা লেখা লিখতে হবে। কী লিখি? হঠাৎ মনে হলো ছোট বেলায় বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদকে আমি চিঠি লিখতাম। বরং এখন একটা চিঠি লিখি না কেন? এখন লিখলে সেই চিঠিটা কেমন হতো? দেখা যাক না...
দাদাভাই
খুব যখন ছোট ছিলাম। তুমি তখন ছিলে ঢাকায়, ঢাকা কলেজের হোস্টেলে থাকতে। মা প্রতি সপ্তাহে তোমাকে চিঠি দিত। মায়ের কড়া নির্দেশ ছিল ছেলেটা একা একা ঢাকায় থাকে, সবাই চিঠি লিখবে। সবাই চিঠি লিখত না। তবে আমি নিয়মিত লিখতাম (লিখার একটা কারণও অবশ্য ছিল- তখন নিজে নিজে লিখতে শিখেছি) আর মা লিখত। আমাদের দুজনের চিঠি একটা খামে ভরে তাকে পাঠানো হতো। তুমি আমার প্রতিটা চিঠির উত্তর দিতে। আমার চিঠিগুলোতে নানান খবর থাকত বাসার, যেমন ‘আমাদের গরুর একটি বাচ্চা হইয়াছে। কুকুরের চারটি বাচ্চার একটি পাহাড়– (আমার বন্ধু) নিয়াছে, ভাইয়া একটি ইঁদুর পালিতেছে ...বিড়াল আবার তিনটি বাচ্চা দিয়াছে...ইত্যাদি টাইপের খবরাখবর। তখন আমরা কুমিল্লায় থাকতাম। আমাদের বাসায় গরু, কুকুর-বিড়াল সবই ছিল। তুমি নিশ্চয়ই আমার চিঠি পড়ে মজা পেতে। কারণ তোমার চিঠিগুলোতে প্রতিটা খবরের প্রতিউত্তর থাকত। একবার মনে আছে আমি তোমাকে ইংরেজিতে চিঠি লিখে বসলাম। ক্লাস টুয়ের ছাত্র ইংরেজিতে চিঠি লিখে কীভাবে? আমার ছোট চাচা ( আলতু কাক্কু ) তখন আমাদের বাসায় ছিলেন, তিনিই আমাকে সাহায্য করেছিলেন। তুমি খুব খুশি হয়েছিলে।
তুমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমেস্ট্রিতে পড়। সে সময় হঠাৎ পেপারে খবর বেরুলো পৃথিবীর অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। তাহলে তো আমরা সবাই মারা যাব অক্সিজেনের অভাবে! আমি চিন্তিত হয়ে তোমাকে লিখলাম এখন কী হবে? তুমি উত্তরে একটা সুন্দর ডায়াগ্রাম একে পাঠালে সেখানে দেখালে পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত কীভাবে অক্সিজেন তৈরি হচ্ছে- যা কখনই ফুরাবে না। সেই চিঠি পড়ে আমার জানে পানি এলো।
তারপর তো ১৯৭১। বাবা শহীদ হলেন, তুমি বন্দী হলে পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে। আশ্চর্যের ব্যাপার তুমি সব ঘটনা বল, কিন্তু তোমাকে নির্যাতনের ব্যাপারটা বলতে চাইতে না। পরে অবশ্য বিচিত্রায় লিখেছিলে, খুবই সংক্ষেপে।
তারপর শুরু হলো আমাদের অন্য জীবন, দুঃখ-কষ্ট আর দারিদ্র্যের জীবন। কী আশ্চর্য! হঠাৎ করে আমরা গরিব হয়ে গেলাম। একটা সুখী পরিবার যারা সুখেই ছিল তারা হঠাৎ করে গরিব হয়ে গেলে কেমন লাগে? পুরানা পল্টনের একটা ছোট্ট ভাড়া বাসায় কম্বলের ওপর শুয়ে ঘুমাতাম। মজাই লাগত, বেশ একটা পিকনিক পিকনিক ভাব চলে এলো আমাদের জীবনে। এটা নিয়েও তুমি মজা করতে।
তারপর একদিন- তুমি বিয়ে করলে, বিদেশে গেলে, একে একে বোনদের বিয়ে হলো। আমরা আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালাম। প্রথম জীবনে আমাদের আনন্দের কেন্দ্রে ছিলেন বাবা। সেই বাবাকে বাদ দিয়েই শুরু হলো আমাদের নতুন জীবন। তবে না, বিদেশ থেকে ফিরে এসে তুমিই হয়ে গেলে আমাদের আনন্দের কেন্দ্র। তোমাকে ঘিরেই আমরা ভাইবোনরা ঘুরতে লাগলাম। নক্ষত্রের চার পাশে যেমন ঘুরে গ্রহরা।
তারপর তো ইতিহাস।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলে একটা কথা আছে, শৈশবের আনন্দ ফিরে এলো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ঘিরে। কারণ তুমিই। তুমিই জান একটা সাধারণ দিনকে কী করে অসাধারণ করে ফেলা যায়। সেটাই করতে তুমি। কী আশ্চর্য সেই তুমি এখন নেই, ( তোমার তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকী চলে এলো )। তোমার ধানমণ্ডির বাসা থেকে এখন আর ফোন করে হঠাৎ হঠাৎ হুকুম কর না আমাকে। আমি মাঝে মাঝে মোবাইলের ফোন লিস্ট খুলে তোমার নামটা দেখি পাশে সেই পরিচিত নাম্বার। কোনো ঈদ সংখ্যায় তোমার লেখা নেই, টিভিতে নাটক নেই। বুকশেলফে নেই নতুন কোনো বই।
এই তো সেদিন গিয়েছিলাম নুহাশ পল্লীতে। তোমার চারপাশে দেখলাম প্রচুর মানুষ, এখনো তারা আসে, দূর দূরান্ত থেকে। কেউ কেউ দেখলাম তোমাকে স্পর্শ করে কাঁদছে। আমার মনে হলো, তোমাকে ঘিরে আছে তোমার উপন্যাসের সব চরিত্র। তোমাকে ঢেকে আছে তোমার নিজ হাতে লাগানো সব ঝাকরা লিচু গাছ। প্রচুর লিচু গাছ, কিন্তু পাড়া নিষেধ কারণ তুমি বলে গেছ এগুলো খাবে পাখীরা। এই গাছ পাখীদের জন্য নির্দিষ্ট।
তুমি বাবা সম্পর্কে বলতে, আমাদের বাবা স্টেইনব্যাকের উপন্যাস থেকে উঠে আসা চরিত্র। তুমিও কি তাই নও? উপন্যাসের চরিত্ররা কখনো মারা যায় না। বই খুললেই তারা জীবিত হয়ে উঠে। তোমার বইগুলো আবার পড়া শুরু করেছি। বই খুললেই তোমাকে কাছে পাই।
একটা কথা আমার খুব ভালো লাগত, তোমার সাথে শেয়ার করি। হয়তো তুমিও শুনেছ। সম্ভবত, তোমার প্রিয় স্বামী বিবেকানন্দের কথা। ‘যে দৃশ্যমান মানুষকে ভালোবাসে না সে কি করে অদৃশ্য ইশ্বরকে ভালোবাসবে?’ তুমি সারা জীবন মানুষকে ভালোবেসেছ , অদৃশ্য মানুষকেও ... যাকে দেখনি কিন্তু তার জীবনের করুণ গল্প শুনে তুমি তাকে না জানিয়েই সাহায্য করেছ- এমন কত ঘটনা আমরা জানতাম, তুমি চলে যাওয়ার পর আরো বেশি জেনেছি। তোমার একটা কথা আমার খুব ভালো লাগে, তুমি কোনো এক উপন্যাসে লিখেছিলে কথাটা- ‘এই পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই!’ কী অসাধারণ বাক্য। আসলে তুমি মানুষের শুদ্ধতম দিকটাই দেখেছ সবসময়, যে কারণে তোমার উপন্যাসে একটা খারাপ চরিত্রও আসলে একজন ভালো মানুষ। সেই তুমি যেখানেই আছ- নিশ্চয়ই ভালো আছ, অবশ্যই ভালো আছ।
শাহীন
(আহসান হাবীবের ডাক নাম)