গল্প পড়ার গল্প
কল্পনা আর বৈচিত্র্যের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আসলে তাঁকে নিয়ে প্রতিনিয়ত এত কথা হয়, তাঁর মস্ত ছায়া যেভাবে ঢেকে রেখেছে তরুণ কবিদের, তা আমাদের জানা। কৃত্তিবাস এবং তরুণ কবিদের শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের চেনা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসও আমাদের চেনা। দীর্ঘ উপন্যাস ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব পশ্চিম’ থেকে তাঁর প্রথম বয়সে লেখা ‘যুবক যুবতীরা’, ‘আত্মপ্রকাশ’, ‘আমিই সে’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ইত্যাদি নিয়ে যত কথা হয়, গল্প নিয়ে তো হয় না। অথচ এই কবির লেখা গল্প তো কবির লেখা গল্পই নয়। জীবনানন্দের গল্প যেমনটা হয়েছিল। যেখানে কবি জীবনানন্দ থেমেছেন, গদ্যকার জীবনানন্দ আরম্ভ করেছেন সেখানে। গল্প লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আর কবি সুনীল সেখানে একেবারেই আলাদা। তিনি বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যময়তাকে অনুসরণ করেছেন সমস্ত বড় গল্পকারদের মতো।
আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের অসম্ভব অনুরাগী। সেই অল্প বয়সে পড়া ‘রাতপাখি’, ‘পলাতক ও অনুসরণকারী’, ‘দূর থেকে দেখা’, ‘গরম ভাত কিংবা নিছক ভূতের গল্প’, ‘যদি, দেবদূত ও বারোহাটের কানাকড়ি’, ‘পুরি এক্সপ্রেসের রক্ষিতা’, ‘খরা’, ‘শাজাহান ও তার নিজস্ব বাহিনি’—কত গল্পের কথা আমি বলব। কতরকম গল্প তিনি লিখেছেন! কত কল্পনা কত বৈচিত্র্য তাঁর গল্পে। কত রকম মানুষ, কত নিরূপায়তা তাদের ভেতর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ছোটগল্পের জন্য চিরজীবী হবেন। আমি সেই ভয়ানক ক্ষুধার গল্প গরম ভাত, খরার কথা আবার মনে করিয়ে দিতে পারি, ভয়ানক দারিদ্র্য আর নিঃসহায়তার গল্প দেবদূতও মনে করিয়ে দিতে পারি, কিন্তু চেনা গল্প থেকে সরে গিয়ে ‘যদি’ গল্পটির কথা বলছি। এই গল্প কল্পিত এক উপমহাদেশের, হ্যাঁ, এখন তা কল্পনারই, তার বাস্তবতা ছিল ১৯৪৭-এ দেশ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার আগে।
দেশভাগে তাঁর পিতৃপুরুষ ফরিদপুর থেকে এই মহানগরে এসে কোনোক্রমে থিতু হন। তাঁর কম বয়সে লেখা ‘অর্জুন’ উপন্যাসে সেই ক্ষতের চিহ্ন আছে। শুধু দেশভাগ নয়, হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িকতা, পারস্পরিক অশ্রদ্ধা... সমস্ত কিছুই ছিল তাঁর মনোকষ্টের কারণ। ধর্মে ধর্মে ভেদ সুনীলকে পীড়িত করত। এক যুক্তিবাদী লেখক অসম্ভব এক কল্পনার কথা লিখেছেন তাঁর গল্পে, যা আপাতভাবে মনে হতে পারে, এমন সোনার পাথরবাটি কি সত্য? ‘যদি’ গল্পটি সেই গল্প, যে গল্পে আছে অখণ্ড এক ভারত।
ধরে নেওয়া যায় এমন একসময়ের গল্প, যখন এখনকার ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ জুড়ে যাবে। শবে বরাতের সন্ধ্যায় গল্পের আরম্ভ। জাহানারা বেগমের নাতনি মিলি বাজি পুড়িয়েছে অনেক, বৃষ্টিতে কিছু রং মশাল নষ্ট হয়েছে। জাহানারা বেগমের স্বামী ছিলেন বেঙ্গল পুলিশের ডিআইজি। তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে সম্প্রতি, তাঁর বড় ছেলে চাকরি করে লাহোরে। মেজো মেয়ে লন্ডনে, বিয়ে করেছে সিলেটের এক ডাক্তারকে। ছোট ছেলে সিরাজ একটি হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে। সে ছিল দামাল। বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, শেষে তাকে পাওয়া যায় হরিদ্বারে। হিমালয় যাত্রা করবে ভেবেছিল। কলেজ জীবনে সে ছিল উগ্রপন্থী। বিহারে কৃষক আন্দোলন করতে গিয়ে খুব মার খেয়ে তিন মাস হাসপাতালে কাটিয়ে ফিরেছিল। এই গল্প ক্রমশ একটু একটু করে অচেনা হয়ে যেতে থাকে। শবে বরাতের পুণ্য রাত। জাহানারা বেগম কোরআন শরিফ পড়ছেন, এই সময় সিরাজের সঙ্গে একটি দম্পতি ওলো বাড়িতে। জয় ও ভাস্বতী। তারা সিরাজের স্ত্রী দীপার দাদা বউদি। জয় নামী নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট। সম্প্রতি তাকে চীন সরকার মাও-জে-দং পুরস্কার দিয়েছে।
এই দম্পতি এসেছে জাহানারাকে তাদের বাড়ির লক্ষ্মীপুজোয় নেমতন্ন করতে। তারা শবে বরাতের রাতে খেয়ে যাবে জাহানারা বেগমের বাড়িতে। এই বাড়িতে মিহি চালের গুঁড়ো দিয়ে চমৎকার রুটি হয় আর তা ভাস্বতীর খুব পছন্দ। জাহানারা সেই সন্ধ্যায় কোরআন শরিফের গল্প বলছিলেন তাঁর নাতনি মিলিকে। কিন্তু তাতে কঠিন আপত্তি সিরাজের। সে চায় না মিলি ধর্ম শিক্ষা পায়। সিরাজ মাকে তার আপত্তির কথা বলে। জাহানারা বলেন, মিলি তাঁদের বাড়িরই মেয়ে, বাপ-দাদার ধর্মকথা একটু আধটু জানবে না? কিন্তু ঘটনা হলো দীপা কিন্তু সিরাজকে বিয়ে করে ইসলাম গ্রহণ করেনি। সিরাজও হিন্দু হয়নি। মিলি তাদের মেয়ে, সে সাবালক হয়ে নিজের ধর্ম ঠিক করবে, সিরাজের কথা তাই। সিরাজের ধারণা তার মা নাতনিকে ধর্ম শিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
সুনীলের এই গল্পে সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হয়নি। অখণ্ড দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জিন্নাহ। ১৫ আগস্ট লাল কেল্লায় তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন মহাত্মাজিকে পাশে নিয়ে। নেহরু ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। জিন্নাহ বলেছিলেন, এখন থেকে যে যার ধর্মমত পালন করবে নিজের নিজের বাড়িতে। ক্রমশ অচেনা হয়ে যেতে থাকে এই গল্পের বাস্তবতা। যা ঘটেনি, ঘটলেও ঘটতে পারত সেই বাস্তবতায় প্রবেশ করতে থাকেন লেখক। এই গল্পের সিরাজ একেবারেই নাস্তিক। সে হিন্দু মেয়ে বিয়ে করলেও হিন্দুঘেঁষা যেমন নয়, রোজাও রাখে না, নামাজ পড়ে না, দীপাদের বাড়ির পুজো-পাঠেও কখনো যায় না। কিন্তু জাহানারা বেগম চান মিলি যেমন রামায়ণ-মহাভারত জানবে, কোরান শরিফের গল্পও জানবে। শবে বরাতের রাতে জয় ও ভাস্বতী সিরাজের মায়ের দাওয়াত গ্রহণ করে তাদের বাড়িতে রান্না গোস্ত খায়। জাহানারা কি ওদের বাড়ি গিয়ে লক্ষ্মী পুজোর প্রসাদ নিতে পারবেন। দীপাদের বাড়ি সাতক্ষীরা। বারাসত থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। ইছামতির সেতু পার হয়ে তারা সাতক্ষীরা যায়।
এই গল্পে চীন আর ভারতে কোনো বিরোধ নেই। দুই দেশের ভেতরে একবার যুদ্ধের পর সন্ধি চুক্তি হয়েছে। দুই দেশ সীমান্ত থেকে সরিয়ে নিয়েছে তাদের সেনাবাহিনী। ফলে প্রতিরক্ষা খাতের খরচ হাজার হাজার কোটি টাকা বেঁচে যাচ্ছে। সেই টাকা দিয়ে সেতু, রাস্তা—কী আশ্চর্য জগতে নিয়ে গেছেন সুনীল। সিন্ধু আর ব্রহ্মপুত্রের ওপর প্রতি কুড়ি মাইল অন্তর ব্রিজ, বম্বে-করাচি সুপার হাইওয়ে হয়েছে। কলকাতা থেকে বাংলাদেশ মাত্র চার ঘণ্টা। জাহানারা বেগম মূর্তিপুজো পছন্দ করেন না। তবু তিনি সাতক্ষীরা রওনা হন বাড়ি ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক সাধারণ মানুষের স্বপ্নের কথা লিখেছেন। করাচি, লাহোর, সাতক্ষীরা, ঢাকা, বারাসাত, কলকাতা একটা দেশ। এই দেশে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরে অন্বিত হয়ে আছে। এই দেশের সীমান্তে প্রহরী নেই। চিন ভারত, দুই প্রতিবেশী উন্নয়নের শিখরে। কী আশ্চর্য! আমি গল্পটির অন্তিমে পৌঁছে থামলাম। পাঠক আপনি আপনার স্বপ্নের সঙ্গে মিলিয়ে নিন। যদি এমন হতো, তাহলে? সুনীল এই গল্পে তাঁর স্বপ্নকে বুনে দিয়েছেন। যা ঘটতে পারত, তা ঘটিয়ে দিয়েছেন। হ্যাঁ, এই গল্প পাঠের পর মন খারাপ হয়ে যায়। কেন হয়নি এমন একটা দেশ? হলেও তো হতে পারত।