কাব্যনাট্যের সৌকর্যে সৈয়দ শামসুল হক
আজ সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী (১৯৩৫-২০১৬)। বহুমাত্রিক সৃষ্টিকর্মের অন্যতম ব্যক্তিত্ব তিনি। তিনিই প্রথম বাংলা কাব্যনাট্যে স্বতন্ত্র ধারা সংযুক্ত করেছেন। এর আগে রবীন্দ্রনাথ থেকে বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত তাঁদের আধুনিক ভাবনায় পৌরাণিক বিষয় ও অঙ্কময় আঙ্গিকের যে ছকটি কাব্যনাট্যে বহুল প্রচলন ছিল, তাকে অতিক্রম করে তিনিই প্রথম সমকালীন জটিল জীবনের বাস্তবতা রূপায়ণে নাটকে কাব্যের মূর্ছনা সঞ্চারিত করেছেন। সব্যসাচী লেখক হিসেবে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। তাঁর বর্তমান কাব্যের সংখ্যা ১৬টির মতো। ছয়টির বেশি গল্পগ্রন্থ এবং একাধিক উপন্যাসের রচয়িতা তিনি। ম্যাকবেথ ও টেম্পেস্টের মতো একাধিক নাটকের সার্থক অনুবাদক ছাড়া 'অন্তর্গত' (১৯৮৪) নামে একটি কথাকাব্যের রচয়িতা তিনি। 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' (১৯৭৬), 'গণনায়ক' (১৯৭৬), 'নূরলদীনের সারা জীবন' (১৯৮২), 'এখানে এখন' (১৯৮২), 'যুদ্ধ যুদ্ধ' (১৯৯১), 'ঈর্ষা' (১৯৯১) প্রভৃতি নাটকের রচয়িতা হিসেবে খ্যাতিমান সৈয়দ হক। ১৯৯১ সালে তাঁর কাব্যনাট্যসমগ্র প্রকাশিত হয়। এতে সংকলিত হয়েছে : পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরলদীনের সারা জীবন, এখানে এখন, গণনায়ক এবং ঈর্ষা।
সৈয়দ শামসুল হকের নাট্যজগতে প্রবেশের বা নাটক রচনা করার একটি ভূমিকা রয়েছে। নিজের বাল্যকালে টাইফয়েডে আক্রান্ত থেকে বেঁচে ওঠাকে তিনি 'নাটকের প্রথম দোলা' বলেছেন। এ সময় থেকে তিনি নাটকের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। নিজেদের ছোট শহরে চিকিৎসক বাবার সঙ্গে শীতের মধ্যে ভ্রাম্যমাণ যাত্রাদলের যাত্রা দেখার অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময় নাটক রচনায় ফলপ্রসূ হয়েছিল। তাঁর যাত্রাপাগল বাবা যৌবনে শখে নাটকে অভিনয় করেছিলেন। একটি নাটকও লিখেছিলেন তিনি। অর্থাৎ পিতৃসান্নিধ্যে বাল্যকাল থেকে নাটকের জন্য তৈরি হয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য অধ্যয়নের সময় মুনীর চৌধুরীর নাটকের মহড়া দেখেছেন। ছাত্রজীবনে বেতার নাটকের অনুবাদ করেছেন এবং টেলিভিশন কেন্দ্রের জন্য মৌলিক নাটক লিখেছেন। তাঁর মতে, 'আমার বলবার কথাটি বলবার জন্যেই একদিন আমাকে কবিতা, গল্প, উপন্যাসের পাশাপাশি নাটককেও ব্যবহার করতে হয়েছে।'
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁকে মুনীর চৌধুরী 'তোমার হাতে নাটক হবে' বলেছিলেন। সে সময় ইংরেজি একাঙ্কিকা অনুবাদ করেছেন তিনি। তবে যৌবনে কবিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও গল্প-উপন্যাসের আঙিনায় পদচারণা ছিল তাঁর নির্বিঘ্ন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় প্রাণিত হয়েছেন তিনি। দেশের সমূহ বর্তমানকে ভাষামাধ্যমে আরো একটি স্তরে প্রকাশ করার দরজা দেখে কবিতার হাত ধরে নাটকে প্রবেশ তাঁর। কারণ তিনি হয়তো মনে করেছেন, খণ্ড কবিতার সব সম্ভাবনা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। সেখান থেকে মুখ ফেরানোর জন্য মহাকাব্য, কথাকাব্য ও কাব্যনাট্য লেখার অনুপ্রেরণা লাভ করেন সৈয়দ হক। কাব্যনাট্য রচনার পরিপ্রেক্ষিত তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন :
“কাব্যনাট্যই শেষ পর্যন্ত আমার করোটিতে জয়ী হয়; টিএস এলিয়টের কাব্যনাট্য-ভাবনা আমাকে ক্রয় করে; আমি লক্ষ না করে পারি না যে আমাদের মাটির নাট্যবুদ্ধিতে কাব্য এবং সংগীতই হচ্ছে নাটকের স্বাভাবিক আশ্রয়; আরো লক্ষ করি, আমাদের শ্রমজীবী মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই হচ্ছে এক ধরনের কবিতাশ্রয়ী উপমা, চিত্রকল্প, রূপকল্প উচ্চারণ করা। আমাদের রাজনৈতিক স্লোগানগুলো তো সম্পূর্ণভাবে ছন্দ ও মিলনির্ভর; লক্ষ করি, আমাদের সাধারণ প্রতিভা এই যে আমরা একটি ভাব প্রকাশের জন্য একই সঙ্গে একাধিক উপমা বা রূপকল্প ব্যবহার না করে তৃপ্ত হই না। ময়মনসিংহ গীতিকা, যা বহু দিন থেকেই আমি নাটকের পাণ্ডুলিপি বলে শনাক্ত করে এসেছি, আমাকে অনুপ্রাণিত করে; একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পঠিত ধ্রুপদী গ্রিক নাটক আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে; শেকসপিয়ার, যাঁর নাটকের কথা বাবা অক্লান্তভাবে বলে যেতেন একদা, যা আমাকে এক তীব্র আলোকসম্পাতের ভেতর দাঁড় করিয়ে রাখে; এ অবস্থায় আমি, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, বিদেশ থেকে ছুটিতে দেশে ফিরে, ঢাকার প্রবল নাট্যতরঙ্গে ভেসে যাই এবং ফিরে গিয়ে রচনা করি ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, এক সংকীর্ণ ঘরে, টেবিলের অভাবে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে হাঁটুর ওপর খাতা রেখে, অফিস যাতায়াতের পথে পাতাল রেলে মনে মনে; এই রচনাটি শেষ করে উঠবার পর মনে হয়, দীর্ঘদিন থেকে এরই জন্য তো আমি প্রস্তুত হচ্ছিলাম।” (ভূমিকা, কাব্যনাট্য সমগ্র)
অর্থাৎ কাব্যনাট্য রচনায় তিনি শেকসপিয়ার ও টি এস এলিয়টের মতো চরিত্রের অন্তর্মুখী সংলাপ সৃজন করেছেন এবং কাব্য ও সংগীতের ঐতিহ্যিক ধারাকে সার্থক ব্যবহারে তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া গ্রিক নাটকের মতো কোরাসের গুরুত্বকে আলোকিত করার জন্য লোকনাট্যের পরিবেশনা-রীতিকে তাঁর কাব্যনাট্যে অঙ্গীভূত করে নিয়েছেন। তাঁর গ্রামবাসী কিংবা লালকোরাস, নীলকোরাস ঠিক ঠিক গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো নয়।
১.
সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম কাব্যনাট্য 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' মুক্তিযুদ্ধের নাটক হিসেবে অধিক পরিচিত। নাটকটির চরিত্রগুলো হচ্ছে—মাতব্বর, পীর সাহেব, মাতব্বরের মেয়ে, পাইক, গ্রামবাসী, তরুণদল ও মুক্তিযোদ্ধাগণ। নাটকটিতে কোনো দৃশ্য-বিভাজন নেই। একটানা কাহিনীর স্রোত বয়ে চলেছে। গ্রামবাসীর সংলাপ দিয়ে এটির শুরু। 'মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা... ক্রমান্বয়ে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী, যুমনার বানের লাহান’—মানুষের এই আগমনের ইঙ্গিতে রয়েছে সব প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রমের সম্ভাবনা। কাহিনীর শেষ মুহূর্তে মাতব্বর শুনেছেন, ‘পায়ের আওয়াজ শুনি মাঠ হয়া পার শত শত হাজার হাজার/ দৌড়ায় আসতে আছে এখানে এবার।' এই পায়ের আওয়াজ আসলে মুক্তিপাগল মানুষের আওয়াজ। যে পদধ্বনি রাজাকার মাতব্বরদের মতো মানুষকে ভীত করে তোলে। শেষে তার মৃত্যু আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বারতা হয়ে ওঠে।
এ নাটকের গ্রামবাসী গ্রিক নাটকের মতো কোরাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। শেষ সংলাপে আছে, ‘আছে দরকার। আছে জরুরি কারণ।... মানুষ সড়ক দিয়া মাথা তুইলা যাবে?’ মাতব্বর গ্রামবাসীকে মুক্তিবাহিনী থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু তার দেশরক্ষার তত্ত্ব শুনে থ হয়ে যায় গ্রামবাসী। মিলিটারি কর্তৃক নির্যাতনের কথায় কর্ণপাত করেনি সে। সে নিজ কন্যাকে এক সৈনিকের হাতে তুলে দেয়। ফলে বিষপানে তার কন্যা মৃত্যুবরণ করে। নারীর সেই যন্ত্রণা নাটকের গভীরে প্রোথিত।
'আমার কি আছে? গ্যাছে সুক
য্যান কেউ নিয়া গ্যাছে গাভীনের বাঁটে যতটুক
দুধ আছে নিষ্ঠুর দোহন দিয়া। সুখ নাই এখন সংসারে
দুঃখেরও শক্তি নাই দুঃখ দেয় আবার আমারে—
যেমন বিষের লতা, তারও জন্ম নাই কোনো নুনের পাহাড়ে।'
কাব্যনাট্যে চরিত্রের মনোজগতের গভীরতল উন্মোচন হয়ে থাকে। এ নাটকে তার স্বাক্ষর পাওয়া যায়।
২.
'নূরলদীনের সারা জীবন'-এ আমাদের মাটির নায়কদের নিয়ে নাটকের মাধ্যমে কিছু করতে চেয়েছেন সৈয়দ হক। যে জাতি অতীত স্মরণ করে না, সে জাতি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে না। এ জন্য যেসব গণনায়ককে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, তাঁদের স্মরণ করা জরুরি। তাতে গণ-অন্দোলনের দীর্ঘদিনের ইতিহাস ও তার মহিমার কথা প্রকাশ পায়। আলোচ্য নাটকে নাট্যকারের সে প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। তাঁর মতে, ‘ইতিহাস থেকে আমি পেয়েছি নূরলদীন, দয়াশীল ও গুডল্যাডকে, কল্পনায় আমি নির্মাণ করে নিয়েছি আব্বাস, আম্বিয়া, লিসবেথ, টমসন ও মরিসকে। নূরলদীনের আত্মা ও প্রেরণা আমি ইতিহাসের ভেতর থেকে সংগ্রহ করেছি, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও মানসিক সংকট আমি সম্ভবপরতার ক্ষেত্র থেকে আবিষ্কার করে নিয়েছি।’
১৪টি দৃশ্যে নাটকটি রচিত। রংপুরের শহর, গ্রাম ও বনাঞ্চল এর স্থান। এর কাল ১১৮৯ বাংলা সন।
প্রস্তাবনা সূত্রধার দিয়ে শুরু হয়েছে। 'নিলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তারা ঐ নীলে অগণিত আর।...' এই প্রস্তাবনার পর লালকোরাস, নীলকোরাস ও নূরলদীনের কণ্ঠ দিয়ে প্রথম দৃশ্যের সূচনা হয়। পর্যায়ক্রমে নূরলদীনকে সাধারণ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার ও চরিত্রটি বিকশিত করার নাট্যিক কৌশল গ্রহণ করতে দেখা যায়। পঞ্চম দৃশ্য থেকে কুঠিয়ালদের আবির্ভাব ঘটে নাটকে। অষ্টম দৃশ্যে নূরলদীনের পিতৃস্মৃতি পারিবারিক জীবন উপস্থাপিত হয়েছে। নবম দৃশ্যে রেভিনিউ সুপারভাইজার মরিস বলেছেন, নূরলদীনকে হিন্দুরাও দেবতার মতো পূজা করে। অথচ সে অনেক মুসলিমের শত্রু। এই দৃশ্যে বিদ্রোহ দমনের কথা শোনা যায়। যুদ্ধের আশঙ্কায় বিচলিত দেখা যায় নূরলদীনের স্ত্রী আম্বিয়াকে দশম দৃশ্যে। দ্বাদশ দৃশ্যে ধ্বনি শোনা যায় 'জয় নবাব নূরলদীন'। ধৈর্য ধরে আন্দোলন করার আহ্বান আসে নেতার কাছ থেকে চতুর্দশ দৃশ্যে। আর রচিত হয় ইতিহাস। যুগে যুগে এ রকম নেতাদের আবির্ভাবের সম্ভাবনা উচ্চকিত হয় সংলাপে।
'এক এ নূরলদীন যদি চলি যায়,
হাজার নূরলদীন আসিবে বাংলায়।
এক এ নূরলদীন যদি মিশি যায়,
অযুত নূরলদীন য্যান আসি যায়,
নিযুত নূরলদীন য্যান বাঁচি রয়।'
নাট্যকার এই গণনায়ককে বাংলার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কিংবদন্তির নেতাদের সঙ্গে একীভূত করে দিয়েছেন। ব্রিটিশ কলোনির নীলকুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নূরলদীনের উত্তরপুরুষ বঙ্গবন্ধু। ইতিহাস-ঐতিহ্য একীভূত এখানে—
'আব্বাস-ভবানী-গরীবুল্লা-হরেরাম
কাঁই সঙ্গে শুনিবে হামার?
কাঁই সঙ্গে জাগিবে হামার?
মজিবর-নেয়ামত-নূরল ইসলাম—
বিপিন-অযোধ্যা-শম্ভু-হায়দার—
এ নিশীথে কাঁই সঙ্গে জাগিবে হামার?'
৩.
দুই অঙ্কের 'এখানে এখন' নাটকে দুটি শ্রেণি-চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এর আগে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা এবং কলোনির উচ্চবর্গ ও স্থানীয় নিম্নবর্গের পরিচয় নাটকে উপস্থাপন করতে দেখা গেছে। এ নাটকে নাট্যকারের ভাষায় 'ব্যবহর্তা আর ব্যবহৃত' দুটি শ্রেণি দেখা যায়। তাঁর মতে, ব্যবহৃত মানুষরাই প্রায় পুরো জনগোষ্ঠী। স্বাধীনতার পর ভিন্নভাষী ব্যবহর্তাদের সরিয়ে নিজেরাই সেই জায়গায় বসেছে কতিপয় মানুষ। নাটকে 'ব্যবহার' শব্দটির নতুন অভিধা আনা হয়েছে। ঠিকাদার মুৎসুদ্দি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম, একই গোত্রের নাসিরুদ্দিন, কালো পোশাকধারী অনামা, কলগার্ল মিনতি, নিঃসন্তান সুলতানা এবং সাদা ও কালো বেশধারী দুজন বিবেক চরিত্রের রূপায়ণ আছে নাটকে।
প্রথম অঙ্কে সাদা পোশাকধারীর কথোপকথন স্বপ্নের মারফতে বিন্যস্ত। দ্বিতীয় অঙ্কে চরিত্রের সংকট বিজড়িত দেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় : ‘স্বাধীনতা এসেছে থেকেই দ্যাখো/ মানুষের মনে স্বস্তি নেই—এ স্বাধীনতা নিয়েই।' সাদা পোশাকধারী বলেছে, 'শিয়রে জননী জাগে, লাশ ভেসে যায় ইতিহাসে।' অন্যদিকে অনামা চরিত্রটি যে শর্টকাট ব্যবসার পথ দেখাচ্ছে, তাতে কালোবাজারির ইঙ্গিত আছে। সুলতানা-রফিক সম্পর্ক বিবাহে মীমাংসিত স্থানে পৌঁছায়নি। মূলত স্বাধীনতা-উত্তর দেশের সংকটকে মধ্যবিত্তের দর্পণে তুলে ধরেছেন নাট্যকার। যাত্রার বিবেক চরিত্রের মতো নাটকে উপস্থাপিত কালো ও সাদা পোশাকধারী আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারায় সম্পৃক্ত।
৪.
'গণনায়ক' উইলিয়াম শেকসপিয়ারের জুলিয়াস সিজার অবলম্বনে রচিত। 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' কাব্যনাটকটি লেখার পর এটি রচনা অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ তিনি রাজনৈতিক কিছু অভিজ্ঞতাকে পরীক্ষা করেছেন এখানে। এ নাটকে তিনি একটি রাজনৈতিক বিবেকের পালা বলতে চেয়েছেন।
সাবেক উপনিবেশ এখন পতাকাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলোর বিবর্তমান রাজনৈতিক চেতনা ও অভিজ্ঞতারই অন্তর্গত—এ কথাগুলো বলার জন্য এই পালার অবতারণা করেছেন তিনি। রাজনীতি ও জীবন, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে ন্যায়-অন্যায়বোধ, দেশপ্রেমের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত, অস্ত্র ও বিবেক—এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করেছেন তিনি শেকসপিয়ারের নাটকে। এটি অনুবাদ বা রূপান্তর নয়। 'জুলিয়াস সিজারে'র ছায়া অবলম্বনে নতুন রচনা। কিছু চরিত্র, কিছু দৃশ্য বর্জন করে নতুন কিছু অংশ রচনা করেছেন তিনি। চরিত্রের নতুন লক্ষণ ও পরিণতি দিয়েছেন। অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্তগুলো স্থাপন করার জন্য এটি করেছেন। ঘটনার অন্তর্নিহিত সত্যের সংবাদ দেওয়ার জন্য বাংলার পটভূমি ব্যবহার করেছেন তিনি।
শেকসপিয়ারের পঞ্চ অঙ্কের নাটকের মতো 'গণনায়কে'রও পাঁচটি অঙ্ক। তৃতীয় অঙ্কে নাটকীয় ক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতি আছে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। এ সময় মির্জা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিকান্দার, সানাউল্লাহ, হুমায়ুন, দাউদ, আবু তাহের চরিত্র বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী হিসেবেই আমাদের পরিচিত মনে হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ওসমানকে হত্যা করে সিকান্দার বলেছে, 'মুক্তি। স্বাধীনতা। নৈরাজ্যের অবসান।' বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ঠিক এ রকমই বলেছিল। তবে নাট্যকারের অভীষ্ট নিহিত আছে এই বাক্যে, 'বাংলার মহত্তম সন্তান তিনি। বাংলাকে ভালোবেসেছেন। যা দিলেন, তিনি ছাড়া কে দিতে পারতেন?' নাটকটির ঘটনা, চরিত্র ও পরিস্থিতি সবই বঙ্গবন্ধু হত্যার ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
৫.
'ঈর্ষা' নাটকে কাব্যনাট্যের চূড়ান্তরূপ দেখিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক। ঈর্ষা হয় প্রেম কিংবা দেহ সংসর্গে। এটাই গ্রাহ্য নাট্যকারের কাছে। ঈর্ষার নির্যাস নিয়ে 'ওথেলো' রচিত বলে তিনি মনে করেন। তবে ওথেলোর ঈর্ষা মানবিক নয়। হত্যা সংঘটনে তা পশুতুল্য হয়ে উঠেছে।
আলোচ্য নাটকে ঈর্ষার মানবিক রূপ তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। মানুষ পারে নিজের ভেতরে একাধিক ব্যক্তিত্বকে অনুভব করতে। নিজের প্রতি ঈর্ষান্বিত হতে। নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। মূলত শেকসপিয়ারের ওথেলো তাঁর অনুপ্রেরণা হলেও তিনি নতুনত্ব সৃষ্টি করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন :
'তিনটি চরিত্র আর তাদের দীর্ঘ সাতটি সংলাপ বয়ন করা হয়েছে এই নাটকের বস্ত্র; প্রচলবহির্ভূত এই করণ বিষয়টির তুলনায় বেশি কৌতূহলের বলে মনে হতে পারে, এমনটি এর পাণ্ডুলিপিকালে কারো কারো মনে হয়েছে; তাই এখানেই বলে রাখা দরকার যে কোনো চমক সৃষ্টির জন্য নাটকের এহেন রূপ আমি নির্মাণ করিনি; ঈর্ষার বিশুদ্ধ একটি মানবিক পরিস্থিতিই আমাকে ঠেলে দিয়েছে চরিত্র-সংখ্যা অন্তিম অবধি কমিয়ে রাখবার এবং অন্তর্মুখী দীর্ঘ সংলাপ বাঁধবার দিকে।'
প্রৌঢ়, যুবতী ও যুবক—এই তিনটি চরিত্রের একের পর এক, অর্থাৎ প্রৌঢ়ের পর যুবতী, তারপর যুবক এবং আবার প্রৌঢ়-যুবক-যুবতী এবং আবারও প্রৌঢ়ের সংলাপে নাটকটি শেষ হয়। যুবতীর রয়েছে স্বামী অথচ প্রৌঢ় আর্টিস্ট তাঁর নগ্ন ছবি পছন্দ করেন। তাঁর আঁকা নগ্নিকা সিরিজের ছবিগুলো প্রদর্শনীতে দিতে চান তিনি। এই পারস্পরিক সম্পর্কের দ্বন্দ্ব নাট্যদ্বন্দ্বে রূপ পেয়েছে। শরীরের অধিকার থেকে বঞ্চিত আশঙ্কায় তাড়িত হয়ে তিনি বলেছেন :
'তোমার নগ্নতার ওপর দিয়ে বহে যাচ্ছে যে নিঃশ্বাস সে আমার এবং আমার?
তুমি তুমি, রক্তমাংসে যে তুমি, আমি সেই তোমাকেই চাই।
আমার ক্যানভাস হোক অমর, তোমার নদীতে আমি মরতে চাই।'
৬.
সৈয়দ শামসুল হকের পাঁচটি কাব্যনাট্য পরিকল্পিত আঙ্গিকে মঞ্চোপযোগী করে রচিত। এ জন্য চরিত্র, মঞ্চ এবং সংলাপ সম্পর্কে নাটকের টেক্সটে তিনি যথাযথ নির্দেশনা দিয়েছেন। 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' গ্রামবাসীর সংখ্যা ২০ হলে ভালো হবে বলেছেন। দুজন ৯০ ও ১০০ বছরের বৃদ্ধ থাকলে ভালো। মঞ্চের নির্দেশনায় বলেছেন, এ নাটকটির মঞ্চ তিনদিকে কালো পর্দা সজ্জিত, মঞ্চের মাঝখানে একটি চেয়ার, কাঁঠাল কাঠের তৈরি, বহু ব্যবহারে তৈলাক্ত ও মসৃণ। দর্শক-সমাগম শুরু থেকেই মঞ্চ আবৃত থাকবে। স্তিমিত একটা সাধারণ আলোর ভেতরে অপেক্ষাকৃত জোরালো আলোয়—চেয়ারটি উদ্ভাসিত হবে। নেপথ্য থেকে বাঁশি ও ঢাকের মিলিত একটা সংগীত শোনা যাবে। সে সংগীত হৃদস্পন্দন অথবা তালে তালে বহু পদশব্দ এগিয়ে আসার অভিব্যক্তি। 'নূরলদীনে'র মঞ্চ হবে খোলা আকাশের নিচে অভিনীত হওয়ার উপযুক্ত। তবে মিলনায়তনে করার জন্য দর্শকদের ভেতর পর্যন্ত মঞ্চ প্রসারিত করতে হবে।
'এখানে এখন' নাটকের দৃশ্যায়ন ঘর ও অফিস নির্ধারণ করা হয়েছে। লম্বা ফাঁকা জায়গাও আছে। সংলাপ ও ভাষার প্রসঙ্গে তিনি মতামত দিয়েছেন। প্রথম নাটকের গ্রামবাসীর সংলাপ একটানা রেখেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, পীর সাহেবের সংলাপ কোথাও ওয়াজের সুরে উচ্চারিত হতে পারে। মাতব্বরের মেয়ের আবির্ভাব মুহূর্ত থেকে নেপথ্য শব্দের মাত্রা বৃদ্ধি করে পরিণতিতে পৌঁছাতে হবে। 'নূরলদীনে' তিনি রংপুরের সাধারণ মানুষের উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। আঞ্চলিক ভাষা এ কাব্যনাট্যে ব্যবহার করলেও তিনি সবার বোধগম্যতার ভেতরে থাকতে চেয়েছেন। 'বলিল' জায়গায় 'বলিলোম', 'সেঠায়' স্থানে সে ঠাঁই ব্যবহার এবং 'ডিং খরচা' এই নামে কৃষকদের কাছ থেকে চাঁদা নিতেন নূরলদীন—এসব তথ্য নাট্যকারের।
সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্যগুলোর অধিকাংশ পাশ্চাত্যরীতিকে পাশ কাটিয়ে নিজস্ব অঙ্কে নির্মাণ করেছেন। এগুলোকে একটি মৌল উদ্দেশ্যে সরাসরি পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেছেন তিনি। বহু দৃশ্য ও অঙ্কময় 'নূরলদীন' ও 'গণনায়কে'র সঙ্গে অপর তিনটির এ জন্য পার্থক্য আছে। এক দৃশ্যে সম্পন্ন হয়েছে এসব দৃশ্যকাব্য। বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্যে সংলাপাত্মক একটি ভঙ্গি নিয়ে প্রচণ্ড গতির মধ্যে একাঙ্ক নাটকের জন্ম। উপরন্তু মানব জীবনের গভীরের দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া এবং ঘটমান কাহিনীর চরম মুহূর্তে স্বল্প সময়ে দর্শক মানসে পৌঁছে যাওয়া একাঙ্ক নাটক রচনার উদ্দেশ্য। একাঙ্কের এই উদ্দেশ্যের সঙ্গে কাব্যনাট্যের অন্তরময় উপলব্ধি বিন্যাসের সম্মিলন লক্ষ করা যায় সৈয়দ হকের নাটকে। তাঁর ভেতর বাজিমাত করার কোনো প্রবণতা নেই। তাঁর কাব্যনাট্যগুলো তাৎপর্যময় কবিতার ছন্দে আলোড়িত। সেখানে উচ্চকিত সংলাপ অনুপস্থিত। বরং ব্যতিক্রমী নাটকীয় উপকরণ ও গভীর জীবনবোধে নির্মিত নাটকগুলো। মধ্যবিত্তের হতাশা কিংবা জোতদার-সমাচার অঙ্কন তাঁর প্রধান প্রচেষ্টা নয় কিংবা মৌলবাদ, বিচ্ছিন্নতার সূত্রও নয়। জীবন-সম্ভূত নাট্যিক ক্রিয়ায় দ্বান্দ্বিক সংঘাতের ভেতর দিয়ে মতাদর্শগত মূল সিদ্ধান্ত মানবিক আবেদনে পূর্ণ হয়ে উঠেছে তাঁর কাব্যনাট্যে। যেখানে উদ্দেশ্য একক, উপায় সংক্ষিপ্ত; সংবেদনা খুব তীব্র। কাব্যনাট্যের এই তীব্র সংবেদনা প্রকাশে সৈয়দ শামসুল হকের দক্ষতা অসামান্য।